মারাকেশের আঁধারের বাসিন্দারা

 


কুতুবিয়া মসজিদ


মারাকেশ শহরের ম্যাকডোনাল্ড মোড়ে ঘোরাঘুরি করছিলাম। আইফোনের ম্যাপ থেকে একটি ঠিকানা খুঁজছি। কিন্তু ওয়াইফাই কাজ করছে অত্যন্ত মন্তরগতিতে। নেটওয়ার্ক এই আসে তো এই চলে যায়। মাথার উপর চড়া রোদ। বাতাসও আছে বলে বেশ সহনীয়। ঘড়িতে বেলা বারোটা। মোটামুটি জমে উঠেছে ফাস্ট ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডের বেঁচাকেনা।

আমাকে দেখে এগিয়ে এল একজন মরোক্কান যুবক। আনুমানিক ৩০-৩৫ বছর বয়স হবে। বসে আছে হুইল চেয়ারে। সাহায্য চায়। পকেট থেকে বের করে দিলাম দেরহাম। তাকে দেখে এগিয়ে এল বোরকা পরিহিত আরেক মহিলা। সেও হাত বাড়ালো। তাকেও দিলাম আরো দেরহাম। জায়গাটা ছেড়ে চম্পট দেয়ার কথা ভাবছি। যে হারে সাহায্য প্রার্থীদের আনাগোনা বাড়ছে তাতে না জানি কোন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ি।

ম্যাকডোনাল্ডের সামনে থেকে চলে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালাম। মেইন রাস্তার একদম পাশে। মনে মনে টেক্সির অপেক্ষা করছিলাম। আমাকে অনুসরন করে হুইল চেয়ার নিয়ে সেই যুবকটি পিছনে এসে দাঁড়ালো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো কিছু লাগবে কিনা। আমি বললাম আমার কিছু লাগবে না। আমি ঠিক আছি।

এবার বেশ রহস্য করে সে বলল, আমি জানি তুমি কী চাও। কিছু চাইলে আমাকে বলতে পারো। আমি সাহায্য করবো। উত্তরে কিছুটা অনুসন্ধিৎসু হয়ে আমিই তাকে বললাম,বেশ তো। আপনি যখন জানেন আমি কী চাই, তাহলে আপনিই সেটা বলুন।

পুরনো শহরের একটি হোটেলের দরজা


এবার সে বলল,মাই ফ্রেন্ড। এখানে এসেছো এন্জয় করতে। সেটাই করো। তোমার যেটা লাগে আমাকে বলো। আমি কম দামে সেটার ব্যবস্থা করবো।

এবার কিছুটা ক্লু পেয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম কমদামে কীসের ব্যবস্থা করবেন? জিনিসটা কি?

ততক্ষণে বোরকা পরা সেই মেয়েটিও পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সামান্য দূরত্ব রেখে সে আলাপচারিতা শুনছে সন্তর্পনে। শিকার শিকারীর খেলায় তার আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে।

পঙ্গু লোকটি তার হুইল চেয়ার ঠেলে আমার একদম পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। বলল তোমার কি কিছু লাগবে না, শুকনো কিছু? কোন ধরণের পাউডার? এইখানে আর কিছু বলতে পারবো না। ওই দেখ, মহিলাটি সব শুনছে। এখানে কিছু বলাটা আর নিরাপদ না। সে অন্যদের বলে দিবে।

দেখলাম সেই মহিলাটি কৌতুহল সহকারে তাকিয়ে আছে। নেকাবের আড়ালে মুখে হাসির আভা বুঝিয়ে দিচ্ছে তার মিঠিমিঠি চাহনি।

হুইল চেয়ারে বসা যুবকটিকে বললাম, কোন রকম নেশায় আমার আসক্তি নেই। আপনি যা মনে করছেন তা ঠিক নয়। এবার সে বলল, ইউ মাষ্ট জোকিং। এখানে তোমার কোন সমস্যা হবে না। সব ব্যবস্থা আমি করবো। কর্ণারে গিয়ে দাঁড়াও। আমার লোকজন ওখানে আসবে।

আমি তার কোন কথা না শুনে সোজা হাঁটা শুরু করলাম। অযাচিত সমস্যা ডেকে আনার কোন মানে হয় না। হোটেলে যেতে কমপক্ষে বিশ মিনিট লাগবে। এভিনিউ করিম আল খাত্তাব এলাকায়। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই পেয়ে গেলাম একটি বাস। উঠে পড়লাম বাসে।

পরদিন হোটেল পরিবর্তন করে চলে এলাম মারাকেশ শহরের পুরনো অংশ মেদিনায়। আমাদের পুরনো ঢাকার ন্যায় ঘিন্জি এলাকা মেদিনা। ছোট ছোট গলি। কয়েকশ বছরের পুরনো বিল্ডিংগুলো নতুন আস্তরনে বসবাসযোগ্য করে রাখা হয়েছে। একই সাথে গড়ে উঠছে অসংখ্য নতুন বিল্ডিং।পথে ঘাটে ইট বালু রাখা। কোন গাড়ি এলেই ধুলোবালিতে একাকার।

ট্যাক্সি হোটেল পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টাও করল না। অনেক দূরেই নামিয়ে দিয়ে গেল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক পিচ্চিকে ডেকে আরবীতে বুঝিয়ে দিল কোথায় নিয়ে যেতে হবে। রাস্তায় হাঁটছি ছেলেটির সাথে কথা বলতে বলতে। ধুমপান করি কীনা জানতে চাইল। এক ফাঁকে একটি নাম্বার দিয়ে বলল কোন কিছুর দরকার পড়লে এই নাম্বারে কল দিলেই তারা আমার হোটেল রুমে পৌঁছে দিবে। হোটেল পৌঁছে বকশিস দিয়ে বিদায় করলাম তাকে।

সেদিন বিকেলে পুরনো শহরে কিছুটা ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরছিলাম। পথ হারিয়ে পড়েছি এক গোলক ধাঁধাঁয়। বেশ কয়েকবার ঘুরাঘুরি করেও হোটেলের রাস্তা পাচ্ছি না। ছোট ছোট গলি। এক মাথা থেকে আরেক মাথায় গিয়ে দেখা যায় সব রাস্তা একই রকম। কয়েকটি রাস্তার মোড়ে ছোট সাইন লাগানো আছে। কিন্তু সেটা ফ্রেন্চ কিংবা আরবিতে। কিছুই বুঝি না।

কয়েকটি ঘর পেরোলেই চোখে পড়ছে মেয়েদের আড্ডা। বিকেলের অবসরে আমাদের দেশের পাড়া গলির মতই বেশ জমিয়ে গল্প করছে মরক্কান মেয়েরা। এদের কাছে ঠিকানা জিজ্ঞেস করাটা মানায় না। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই পেলাম কয়েকজন কিশোর। এদের একজনের কাছে বললামদ্বার আল নাবিলাহোটেলে যেতে চাই। পথটা কোন দিকে।

মারাকেশের একটি হোটেল

                                                    মারাকেশের একটি হোটেল


ছেলেটি আমাকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে এল। এটা সেটার ফাঁকে সেও জিজ্ঞেস করলো কোন প্রকার ড্রাগ লাগবে কীনা।আমি বললাম কি আছে তোমার কাছে? বললো, যেটা চাও সেটাই দেয়া যাবে। এমনকি তোমার হোটেল রুমেও।

আমি প্রশ্ন করলাম, এই মুহুর্তে কি আছে তোমার কাছে? সে বলল, হাসিস। বললাম, আমার এসব লাগবে না। তুমি আমাকে এগিয়ে দিয়েছো, এজন্য কিছু টিপস নিয়ে যেতে পারো। সে বলল, লাগবে না।

পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যে ফিরে আমার এক আলজেরিয়ান সহকর্মীকে বলছিলাম এই ব্যাপারগুলো। সে বলল, আর নতুন কী! মরক্কোর রাজা নিজেই মাদক চোরাকারবারী। তাদের আয়ের একটা বড় অংশ আসে মাদক ব্যবসা থেকে। ড্রাগের প্যাকেটে অনেক সময় তাদের রাজার ছবি লাগানো থাকে!

ইউরোপীয়ান পর্যটকদের আনাগোনায় মারাকেশের অধিবাসীদের একটি বড় অংশের অন্যতম আয়ের উৎস পর্যটননির্ভর ব্যবসা। সেখানে আলো ঝলমলে চাকচিক্যময় বাণিজ্যের সাথে ইদানিং আঁধারের কালো হাতছানিময় মাদকের রমরমা কারবারও বেশ পসরা সাজিয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকরা নেপথ্যে থাকায় আঁধারের এসব ক্ষুদে বাসিন্দাদের নিয়ে কেউ হয়তো আর মাথা ঘামান না।

 

বদরুল হোসেন বাবু: ফ্রি-ল্যান্স লেখক, ব্লগার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ