লেক ডিষ্ট্রিক্টের পথে





 এডিনবরার আবহাওয়া সাধারনত মেঘলা থাকে। এখানে এখন গ্রীষ্মকাল। আমরা রওনা হয়েছি সকাল বেলা। এডিনবরায় একটু ঠান্ডা থাকলেও ইংল্যান্ডে এখন মোটামুটি গরম। আজ আমরা  যাচ্ছি স্কটল্যান্ডের মেঘলা আবহাওয়া থেকে ইংল্যান্ডের মোটামুটি ঝকঝকে আবহাওয়ায়।


রাস্তার দুইদিকের গাছপালা দেখে  মনে হত পারে এটা বাংলাদেশ কিংবা ভারতের 

দূরপাল্লার রাস্তার মতই। ইংল্যান্ডে যখন সামার টাইম তখন প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী মনোরম সবুজ দেখায়। কিছুদিন পর অবশ্য এই চেহারা পাল্টে যাবে। শীতের আবির্ভাবে গাছগুলো থেকে পাতা ঝরার পর মনে হবে এ এক মৃত নগরী।


রাস্তার দুইপাশে দৃশ্যমান হচ্ছে মাঠের পর মাঠ। এইসব মাঠে এখানে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। অবশ্য আগেকার আমলে এখানে চাষাবাদ হত সেই পুরনো ষ্টাইলেই। কৃষক কৃষাণীর পদভারে মুখরিত থাকত ফসলের মাঠ। মাঠ থেকে পাকা ফসল আহরনের দৃশ্যাবলী অপূর্ব। এমনই যে তাতে কবি সাহিত্যিকদের মনও উতলা হয়ে উঠে।


পাঠক, আপনি যদি ছাত্রজীবনে ইংরেজ পাঠ্যে দ্য সলিটারী রিপার কিংবা ড্যাফোডিল পড়ে থাকেন তাহলেই মনে পড়বে এর রচয়িতা বিখ্যাত ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়র্ডসওয়ার্থের কথা। দ্য সলিটারী রিপার কবিতাটিতে কবি এক গ্রামীন কৃষাণীর গানের সুরের মজে ছিলেন। যে সুর কবির হৃদয়ে তুমুল আলোড়ন তুলেছিল। যদিও কবি সেই কাল্পনিক কৃষাণীর গানের কথাগুলি বুঝতে পারেন নি। কিনতু তার গানের সুরের  একটা দীর্ঘ্যস্থায়ী আবেদন ছিল।


প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রুপে মশগুল ইংলিশ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের পরিচিতি মূলত: নিসর্গের কবি হিসাবে। ১৭৭০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ককারমাউথ নামক স্থানের এই বাড়িতে। বাড়িটি নির্মিত হয় ১৭৪৫ সালে এখানকার কাম্বারল্যান্ড প্রদেশের প্রধান বিচারপতি জশোয়া লুককের জন্য। পরবর্তীতে স্থানীয় একজন জমিদার জেমস লাওদার বাড়িটি কিনে নেন। তিনি এখানে বিনা ভাড়ায় থাকতে দেন জন ওয়ার্ডসওয়ার্থকে, যিনি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের পিতা এবং লাওদারের প্রতিনিধি।। এই বাড়িতে অবশ্য কবি বাস করেছিলেন শৈশব কালিন সময়ে। ৮ বছর বয়সে মাকে হারালে তারা আর এই বাড়িতে থাকেন নি। আরো পাঁচ বছর পর কবির বাবাও মারা যান। তখন খালি হয়ে যায় এই বাড়ি।

পরের দেড়শ বছর বাড়িটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বসতভিটা ছিল। এর অবস্থান শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হওয়ায় ১৯৩০ সালে স্থানীয় একটি বাস কোম্পানী সেটি কিনে নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাড়ি ভেঙ্গে সেখানে একটি বাস ষ্টেশন নির্মান করবে। একই সময়ে স্থানীয় একটি লাইব্রেরীও চেষ্টা করেছিল বাড়িটি কিনে নিতে। কিন্তু তাদের ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। বিষয়টি রেডিও এবং সংবাদপত্রে ব্যাপক প্রচার পায়। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা অনুদান প্রদান করলে বাড়িটি কিনে নেয়া হয় লাইব্রেরীর পক্ষ থেকে। প্রদান করা হয় জাতীয় ট্রাষ্টে। তাদের তত্বাবধানে ১৯৩৯ সালের ৩০শে জুন থেকে এটি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মেমোরিয়াল হিসাবে পরিচিতি পেয়ে আসছে।

২০০৪ সালে বাড়িটিতে আরও সংস্কার করা হয় এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের ছোটবেলায় যে রকম ছিল সেভাবেই সাজানো হয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথায় বিন্যস্ত রান্নাঘর, বাচ্চাদের শয়নকক্ষ, কবির পিতার অফিস কক্ষ এবং পরিবারের ব্যবহার্য অন্যান্য কক্ষগুলোও অতীতের সাজশয্যায় ফিরিয়ে নেয়া হয়।

বাড়ির পিছনের বাগান যা ডারউইন্ট নদীর তীরে অবস্থিত সেটিকেও অষ্টাদশ শতকের সৌষ্টবে রাখা হয়েছে। নদীর কলকল কলরবে সেখানে অপূর্ব এক নৈসর্গিক আবহ বিরাজ করছে। এ বাড়িটির অপরূপ প্রাকৃতিক শোভাই হয়তো কবির অবচেতন মনে নিসর্গ প্রেম কে তাঁর কাব্যের অন্যতম এক অনুপ্রেরণা হিসেবে উদ্দীপিত করেছে।

ওয়ার্ডসওয়ার্থ হাউজের বিপরীত দিকেই রয়েছে নানা বৈচিত্র‍্যময় ফুলের সমারোহে সাজানো একটি বাগান। ভিতরে কবির একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। যেন একান্ত নিভৃতে নিসর্গকে অবলোকন করছেন কবি! দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি? মনোরম পরিবেশের এই বাগানটি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মেমোরিয়াল নামেই পরিচিত।

কবির বাড়ি থেকে বের হয়ে আমরা রওনা হলাম ককারমাউথ নামক শহরের মধ্য দিয়ে নিকটবর্তী সমুদ্র উপকূলের উদ্দেশ্যে। শহরের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন নান্দনিক কারুকাজ আর সাজানো ফুলবাগানের ছবি ছবি নয়ন মনোহর। এই জায়গাটির নাম হোয়াইট হ্যাভেন। বাংলায় বলা যায় শ্বেত স্বর্গ। 


 সপ্তদশ শতকে লন্ডনে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয় যাতে শহরের বেশিরভাগ স্থাপনা পুড়ে যায়। সেই দু:সহ অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসাবে এই শহরের গোড়াপত্তন করা হয়। এখানে গড়ে উঠে কয়লা ও লৌহ শিল্প। ক্রমেই হোয়াইট হ্যাভেন পরিণত হয় ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় প্রধান বন্দরনগরীতে। এই শহরের সাথে আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক খুবই শক্তিশালী ছিল। আমেরিকার বিখ্যাত প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের দাদীর সমাধি এই শহরেই।


হোয়াইট হ্যাভেনে আছে একটি বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত। করোনার কারনে এখানে পর্যটক তেমন আসেননি। তবে বছরের এই সময়টা সাধারণত এখানে জমজমাট থাকে। 


আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লেক ডিষ্ট্রিক্ট। নাম থেকেই বুঝা যাচ্ছে এটা পর্যটন বান্ধব এলাকা। আসলে এটা একটা পুরো জেলা। বিভিন্ন ছোটবড় পাহাড় আর লেইকের সমন্বয়ে এই লেক ডিষ্ট্রিক্ট। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকালে চোখে পড়ে দুইপাশের সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী। এই এলাকার বিখ্যাত লেইকের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উইন্ডারমেয়ার এবং এমব্লেসাইড। পাহাড় এবং লেকের মনোরম দৃশ্যাবলী অবলোকন করতে এখানে এই সময়ে বেড়ে ওঠে পর্যটকদের আনাগোনা। তবে আরেকটি এলাকায় বিভিন্ন রকম ওয়াটার রাইড এবং নৌকাবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে। সেটি হচ্ছে কনিষ্টন। লেক ডিষ্ট্রিক্টের মনোরম দৃশ্যাবলী উপভোগ করার জন্য এখানে সময় নিয়ে আসতে হয়।  

-বদরুল হোসেন বাবু


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ