হারানো দিনের সিনেমা রিভিউ : প্রতিমা




কাহিনী ঃ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। খগেন রায় পরিচালিত " প্রতিমা " ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪৬ সালের ২০ শে ডিসেম্বর ছবিঘর, মিনার, বিজলী সিনেমাহলে।
চিত্রনাট্য রচনা ঃ খগেন রায়।
সুরকার ঃ সমরেশ চৌধুরী।
গীতিকার ঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অজয় ভট্টাচার্য্য, সমরেশ চৌধুরী।
আলোকচিত্রী ঃ নিমাই ঘোষ।
শিল্পনির্দেশক ঃ মণি মজুমদার।
শব্দযন্ত্রী ঃ নৃপেন পাল।
পরিবেশনা ঃ এসোসিয়েট ডিস্ট্রিবিউটার্স।
প্রযোজক ঃ কানাইলাল ঘোষাল।

মুভি টেকনিক সোসাইটির ব্যানারে নির্মিত, " প্রতিমা " ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ঃ
শিপ্রা দেবী, প্রমীলা ত্রিবেদী, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, ফণী রায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্ত্তী, আরতি দাস, রাজলক্ষ্মী, অহী সান্যাল, দেবু মুখোপাধ্যায়, অনুপ সরকার, অলকা মিত্র, ছবি চট্টোপাধ্যায়, মধুসূদন চট্টোপাধ্যায়, মঞ্জু চট্টোপাধ্যায়।
প্রতিমা ছবির গান ঃ
১.
তুই মুখ দেখাবি কেমন করে রাই লো
চারিদিকেই ধিক ধিক করে যে সবাইলো।
কলঙ্কিণী চাঁদ ওরে তুই কাল নিশুতি রাতে
নীলাম্বরের কোলে ছিলি কোন সে চাঁদের সাথে !
চাঁদ ডুবেছে ডুবলি না তুই মরণ কি তোর নাই লো
তোর ঘর জ্বালানী রূপের ডালি।
তুই গোকুলের কূল মজালি,
ঐ চম্পাবরণ যৌবনে তোর কৃষ্ণপ্রেমের দাগ লাগালি
শুকতারা আর শুকসারি তাই তোর অপযশ গাইলো।
কথা ঃ শ্রী মোহিনী চৌধুরী।
২.
তোরে কে দিয়েছে দোলা।
কোন সে মনের মণি কোঠায়
দুয়োর পেলি খোলা !
আপন মনে ছিলি চুপি চুপি
তোর পড়লো ধরা সকল কারচুপি
সকল ক্ষণে বাহির হলি ওরে আপন ভোলা
কোন স্বপন পারের পেয়েছিলি ডাক
এখন পাগল হাওয়ায় ঘূর্ণি হয়ে থাক,
এই যে প্রাণের ঢেউ লেগেছে গানে
এই চঞ্চলতার পুলক যে আনে
কোন গোপনের ঝরণা ধারায় করেছে কল্লোল।
কথা ঃ শ্রী সমরেশ চৌধুরী।
৩.
কিছু বলব ব'লে এসে ছিলেম
রইনু চেয়ে না বলে।
দেখিলাম খোলা বাতায়নে
মালা গাঁথ আপন মনে
গাও গুন গুন গুঞ্জরিয়া যুঁথি কুড়ি নিয়ে কোলে।
সারা আকাশ তোমার দিকে
চেয়েছিল অনিমিখে,
মেঘ ছেঁড়া আ'লো এসে পড়েছিল কালো কেশে
বাদল মেঘে মৃদুল হাওয়ায় অলক দোলে।
কথা ঃ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৪.
সৈনিক তুমি দুর্জ্জয় বীর পথ চলো হুঁসিয়ার
অত্যাচারে ইস্পাতী বাজ গড়িয়াছে আঁধিয়ার।
যুগে যুগে আসি বর্গীর দল
কেড়ে নিতে চায় প্রাণের ফসল
মোদের শোণিতে রঞ্জিত করি সঙ্গীন তলোয়ার।
সৈনিক হুঁসিয়ার।
হিমালয় আর ককেশাসে এক মিতালীর হাওয়া বয়
বন্ধু তোমরা মাটির মানুষ এই শুধু পরিচয়।
নহেতো শঙ্খ, সাইরেন ধ্বনি
জয় যাত্রায় উঠিয়াছে রণি
বিশ্ব - ভূখার সমান দাবীতে ভাঙ্গো যজ্ঞের দ্বার।
সৈনিক হুঁসিয়ার।
কথা ঃ শ্রী অজয় ভট্টাচার্য্য।
৫.
ওহে সুন্দর মরি মরি
তোমায় কি দিয়ে বরণ করি।
তব ফাগুন যেন আসে
আমি মোর পরাণের পাশে
দেয় সুধারস ধারে ধারে মম অঞ্চল ভরি ভরি।
মধু সমীর দিগঞ্চলে
আসে পুলক পূজাঞ্জলী
মম হৃদয়ের পদতলে
যেন চঞ্চল আসে চলি।
মন মনের বনের শাখে
যেন নিখিল কোকিল ডাকে
যেন মঞ্জরী দীপশিখা
নীল অম্বরে রাখে ধরি।
কথা ঃ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৬.
আনমনা, আনমনা,
তোমার কাছে আমার বাণীর মালাখানি আনব না।
বার্তা আমার ব্যর্থ হবে
সত্য আমার বুঝবে কবে
তোমার মন জানবে না।
লগ্ন যদি হয় অনুকূল মৌন মধুর সাঝে
নয়ন তোমার মগ্ন যখন ম্লান আলোর মাঝে
দেবো তোমায় শান্ত সুরের সান্ত্বনা
ছন্দে গাঁথা বাণী তখন পড়ব তোমার কানে
মন্দ মৃদুল তানে
ঝিল্লি যেমন শালের বনে নিদ্রা নীরব - রাতে
অন্ধকারের জপের মালায় একটানা সুর গাঁথে।
একলা তোমার বিজন প্রাণের প্রাঙ্গণে
প্রান্তে বসে একমনে
এঁকে যাবো আমার গানের আলপনা।
কথা ঃ শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কাহিনী ঃ
হিরন্ময় চৌধুরী বয়সে যুবক ও সঙ্গতিপন্ন হলেও বিলাস - ব্যসনের প্রতি ঝোঁক তার একটু বেশী রকমের।
আর এ জন্যই হিরন্ময় চৌধুরী মদ্যপ ও অমিতাচারী।
বন্ধুবান্ধব নিয়ে হিরন্ময় চৌধুরী একদিন শ্যামগঞ্জের মেলায় চলেছে -
হঠাৎ বুড়ো সদানন্দের নাতনী টুনু হিরন্ময় চৌধুরীর গাড়িকে পথ করে দিতে গিয়ে পাশের নিচু জায়গায় পড়ে গেল ।

হিরন্ময় চৌধুরী বাধ্য হয়ে টুনুকে নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। একরাত ওখানেই টুনুর কাটলো।
বুড়ো সদানন্দ খবর পেয়ে পরদিন জমিদার বাড়িতে গিয়ে টুনুকে কেবল ফিরিয়েই পেল না, ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তার বিয়েতে দেবার জন্য পাঁচশো টাকা এবং জমিদারী সেরেস্তায় একটি চাকরিও পেল।
সদানন্দের চাকরি পাওয়া মানে গোমস্তা হারাধন সরকারের চাকরি খতম।
কিন্তু হারাধনের চাকরি গেল না, কারণ হিরন্ময় চৌধুরী ইতোমধ্যে হারাধন সরকারের বাড়ি গিয়ে তার প্রতিমা - নীলিমার মত শালীকর দেখে বিস্মিতই হয়ে পড়লো।

এক রাতে নেশার মাত্রা বেশ একটু চড়িয়ে হিরন্ময় চৌধুরী অভিসারে বের হলো।
প্রতিমা বাড়িতে একাই ছিল সেদিন । তবু সে মাতাল হিরন্ময় চৌধুরীকে অভ্যর্থনা করতে ভয় পেল না।
তাই হিরন্ময় চৌধুরী জয় করতে গিয়ে বিজিত হয়ে ফিরে এলো।
প্রতিমাকে পাওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা হিরন্ময় চৌধুরীকে পেয়ে বসলো।
কিন্তু বোনের বিয়েতে যৌতুক স্বরূপ দেয়া পাঁচ হাজার টাকার চেক স্বচ্ছন্দে ফিরিয়ে দিয়ে প্রতিমা হিরন্ময় চৌধুরীকে নিরাশ করে কলকাতায় ফিরে গেল।
ঠিক এমনি সময়ে সদানন্দ এসে কেঁদে পড়লো -
তার নাতনী টুনুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

টুনুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল কিন্তু যে মেয়ে হিরন্ময় চৌধুরীর বাড়িতে রাত কাটিয়েছে তাকে বউ করা চলে না বলে বিয়ে ভেঙে গেছে।
হিরন্ময় চৌধুরী টুনুর সন্ধানে বেরিয়ে যখন তার খোঁজ পেলো তখন টুনু আত্মগ্লানিতে মরতে চলেছে।
হিরন্ময় চৌধুরী টুনুকে মরতে দিলো না -
বরং বিয়ে করলো টুনুকে।

এদিকে হিরন্ময় চৌধুরীর মনে অতৃপ্তের আগুন জ্বলছে।
যে করেই হোক তাকে পেতে হবে - প্রতিমাকে।
ফলে হিরন্ময় চৌধুরী ও টুনুর দাম্পত্য জীবনে শুরু হল অশান্তি আর অশান্তি।
দুঃখিনী টুনুর অদৃষ্টে সুখ ভোগ সম্ভব হলো না।

স্বামীকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়ে সূতিকাগারেই টুনু মারা গেল।
শেষ পর্যন্ত প্রতিমা হিরন্ময় চৌধুরীর জীবন সাথী হয়ে সে ওই পুত্র সন্তানটির ভার নিল।

লিখেছেন: লিয়াকত হোসেন খোকন।


9



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ