সবুজ শ্যামল আগরতলা

  




ত্রিপুরার আগরতলায় বেড়াতে গিয়ে যে রংটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হলো সবুজ। শুধু সবুজ রঙের কত রকমশেডহতে পারে তা চাক্ষুষ করতে হলে ত্রিপুরাতে একবার আসতেই হবে। ভাবলে অবাক লাগে যে মাত্র ১০,৪৯২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এক ভূখন্ডের প্রকৃতিকে কত রূপেই না দেখা যায়। ত্রিপুরায় রয়েছে বিভিন্ন বন্য প্রাণী-অধ্যুষিত গভীর অরণ্য, টিলা, পাহাড়, ঝরনা, সরোবর। চা, রবার, কমলালেবু, আনারসের বাগান এবং বিস্তৃত কৃষিজমি।

এছাড়া পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য রয়েছে অভিনব নীরমহল প্রাসাদ, মাতাবাড়ির বিখ্যাত সতীপীঠ, ঊনকোটির অতুলনীয় ভাস্কর্য, চিরবসন্তের দেশ জম্পুই, পিলাকের সুপ্রাচীন প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন এবং বিভিন্ন উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।



আগরতলা

আগরতলা এক আপাদমস্তক বাঙালি শহর। এখানকার বাঙালিদের কথায় বাংলাদেশের কুমিল­ জেলার প্রভাব খুব বেশি। এরা অত্যন্ত অতিথিবৎসল, সংস্কৃতি সচেতন এবং ভোজনরসিক। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের আজীবন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠাকালে ত্রিপুরার রাজপরিবার নানাভাবে রবীন্দ্রনাথকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ মোট সাতবার ত্রিপুরায় এসেছিলেন। প্রথমবার এসেছিলেন ১৮৯৯ সালে, মহারাজ রাধাকিশোরের আমন্ত্রণে এবং শেষবার এসেছিলেন ১৯২৬ সালে মহারাজ বীরবিক্রমের নিমন্ত্রণে।

ত্রিপুরার রাজাদের আমলে তৈরি প্রাসাদ, মন্দির এবং দিঘি ছড়িয়ে আছে আগরতলা শহরজুড়ে। বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিচে দেওয়া হলো।

উজ্জয়ান্ত প্রাসাদ

রাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের উদ্যোগে, ইন্দো-সেরাসেনিক স্থাপত্যশৈলীকে অনুসরণ করে এই দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল ১৯০১ সালে। প্রাসাদে প্রবেশপথের দুধারে রয়েছে দুটি বিশাল দিঘি। দুই দিঘির মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে সিংহদুয়ার থেকে প্রাসাদ পর্যন্ত রাস্তা চলে গিয়েছে। পথের দুধারেই রয়েছে ফুলের বাগান। বর্তমান উজ্জয়ান্ত প্রাসাদ দেখে হতাশ হতে হবে, কারণ প্রাসাদটিকে বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংস্কার করা হচ্ছে। উজ্জয়ান্ত প্রাসাদ বহু বছর ধরে ত্রিপুরার বিধানসভা ভবনের প্রয়োজন মিটিয়েছে। নতুন বিধানসভা ভবনের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। উজ্জয়ান্ত প্রাসাদের সংস্কার সম্পূর্ণ হলে এই অনুপম ভবনটিকে সংগ্রহশালায় রূপান্তরিত করা হবে।

মালঞ্চ নিবাস

সময়োচিত সংস্কারের অভাবে এই অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যটির এখন করুণ দশা। মালঞ্চ নিবাস তৈরি করতে কলকাতার নামকরা স্থপতি এবং বাস্তুকারদের আগরতলায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ভবনটির নির্মাণশৈলীর অভিনবত্ব দেখে তাক লেগে যায়। এই বাড়িতে বাস করার সময় রবীন্দ্রনাথ বিসর্জন নাটকটি রচনা করেছিলেন। মালঞ্চ নিবাসের অবস্থান কুঞ্জবন প্রাসাদের (বর্তমান রাজ্যপালের নিবাস) অদূরে।

কুঞ্জবন প্রাসাদ

এই সুন্দর প্রাসাদটি মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মাণিক্য ১৯১৭ সালে তৈরি করিয়েছিলেন। প্রাসাদের সামনেই রয়েছে যত্নলালিত উদ্যান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ ত্রিপুরা ভ্রমণের সময় এই ভবনটিতে বাস করেছিলেন। বর্তমানে এই প্রাসাদটি রাজ্যপালের নিবাসস্থানরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে তাই প্রাসাদ চত্বরে প্রবেশ করতে হলে রাজ্যপালের জনসংযোগ অধিকারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

স্টেট মিউজিয়াম

এই রাজ্য সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হলো ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের অমূল্য সংগ্রহ। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উলে­খযোগ্য প্রাচীন ভাস্কর্যগুলো হলো পাথরের তৈরি ত্রিমূর্তি, ভৈরব, বামনাবতার, কৃষ্ণ, কুর্মাবতার, নৃসিংহ অবতার এবং ব্রোঞ্জের তৈরি অবলোকিতেশ্বর, রত্নসম্ভব, বিষ্ণু, বুদ্ধ এবং সর্বমঙ্গলা মূর্তি।

ত্রিপুরার রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত ঐতিহাসিক সামগ্রীর সংখ্যাও কম নয়। মিউজিয়ামের দোতলায় রয়েছে উপজাতীয়দের বসন-ভূষণ, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত সামগ্রীর সংগ্রহ এবং মহারাজাদের তৈলচিত্র।

প্রতি রবিবার এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোতে মিউজিয়াম বন্ধ থাকে। সংগ্রহশালা খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত

জগন্নাথ মন্দির

উজ্জয়ন্ত প্রাসাদের পাশেই অবস্থিত এই বিখ্যাত মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্য (রাজত্বকাল ১৮৯৬-১৯০৯) অষ্টকোণ দেউল বিশিষ্ট এই মন্দিরের নাটমন্দিরটি বিশাল। কৃষ্ণের জীবন নিয়ে তৈরি গ্যালারিটি জগন্নাথ মন্দিরের অন্যতম আকর্ষণ।



আগরতলা শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্যগুলো হলো :

বেণুবন বিহার বুদ্ধমন্দির, আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, উমা-মহেশ্বর মন্দির, মহারাজা বীরবিক্রম কলেজ, গেদু মিয়ার মসজিদ, অর্কনীড় এবং ত্রিপুরার হস্তশিল্পসামগ্রীর সেলস এম্পোরিয়াম পূর্বাশা

-লিয়াকত হোসেন খোকন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ