সিলেট: ক্ষণিকের সাথী জীবন ভরিয়া খুঁজি

 


হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর পণ্যভূমি সিলেট। প্রাচীন গৌড়ের রাজা গৃহক তার প্রিয় মেয়ে শীলার স্মৃতির সাথে একটি হাট স্থাপন করে নাম রাখেন শীলাহাট। এই শীলাহাট থেকে সিলেট নামের উৎপত্তি। পরে শ্রীহট্ট, অবশেষে সিলেট।

সিলেটে দেখবেন - ঢেউ খেলানো চা বাগান, হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার, ওসমানী জাদুঘর, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, মুরারি চাঁদ কলেজ, কিন ব্রিজ, আলী আমজাদের ঘড়ি, চাঁদনি ঘাটের সিঁড়ি, হযরত শাহ পরানের মাজার, শাহী ঈদগাহ, গৌর গোবিন্দের টিলা। সিলেট শহরের বাইরে দর্শনীয় জায়গা হলোÑ শ্রীপুর, জাফলং, তামাবিল জৈন্তাপুর। এছাড়া সিলেটের ঢাকা দক্ষিণগ্রামে দেখবেন শ্রীচৈতন্যদেবের মন্দির। এটি রয়েছে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। সিলেট থেকে জাফলংয়ের দূরত্ব ৪৩ কিলোমিটার। এর যে কোনো জায়গায় সড়কপথে বাসে যেতে সময় লাগে দেড় থেকে ঘণ্টার মতো।

যেভাবে যাবেন:

সিলেট যাওয়ার জন্য সড়কপথে বাস, রেলপথে চলে ট্রেন। এছাড়া আকাশ পথে রয়েছে বিমান। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছাড়ে সিলেটগামী পারাবত, জয়ন্তিকা, কালনি, উপবন প্রভৃতি আন্তনগর ট্রেন। সময় লাগে ঘণ্টা।

সিলেট যেখানে থাকবেন :

সিলেটে রাতযাপন করার জন্য রয়েছে হোটেলের ছড়াছড়ি। যেমনÑ হোটেল ডালাস, হোটেল অনুরাগ, ফরসুন গার্ডেন, হলি গেট, রুজবি, হিল টাউন, গুলশান, পলাশ হোটেল, অনুরাগ, বেলি গার্ডেন।

কত টাকা খরচ হবে : থেকে দিন সময় হাতে নিয়ে যাবেন সিলেটে। ভ্রমণে থেকে হাজার টাকা নিয়ে গেলেই চলবে।

সিলেট ভ্রমণ কাহিনী :

এই ঈদে সিলেট ভ্রমণের কথা উঠতেই এখনও মন ব্যাকুল হয়, মনে পড়ে পুরনো কতই না কথা। তখন ইচ্ছে হয় আবার সিলেট যাব। দেখব দুনয়ন ভরে সিলেটের রূপ। এই সিলেটের উত্তরে ভারতের আসাম এবং মেঘালয় রাজ্য। এই জেলার উপজেলাগুলো হলো - সিলেট সদর, বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জে, কোম্পানিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, ওসমানি নগর, জৈন্তাপুর আর গোলাপগঞ্জ। এর যেখানে যাবেন সেখানেই খুঁজে পাওয়া যায় নৈসর্গিক শোভা।



একবার সিলেটের চা বাগাননে ঢুকে তো অবাক। যেদিকে তাকাই দেখি বনপথ। সঙ্গী ছিল সাকিব চৌধুরী।

ওদিকে সিলেটের ভাদেশ্বরের রূপে মুগ্ধ হয়ে দেখি এক পথিক গান ধরল :

সেখায় নাকি মন হারালে পায় না মনের দেখা

পথের বাঁকে নতুন পথের শুরু

না পাওয়াকে পাওয়ার আশায় হিয়া দুরু দুরু

পাতার বাঁশি বাজায় বসি,

পাহাড়িয়া কোন ছেলে

ফুলের গন্ধ মেখে বাতাসে

একটি নিঃশ্বাস যায় জ্বলে....

ভাদেশ্বর দেখে সিলেট ফিরে এলাম দুজনে। সিলেট শহরে ঢোকার আগেই ভাবলাম, আবারও সিলেট দেখব। কিন ব্রিজ পেরিয়ে হযরত শাহজালালের (রহ.) দরগায় যাওয়া নাহয় ওখান থেকে শাহী ঈদগাহ দেখতে গিয়ে ওখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকাÑ সে কথা কি ভোলার! এবারও যাব ওই শাহী ঈদগায়। হঠাৎ সাকিব চৌধুরী বলল, সিলেট শহরে রয়েছে মালিনি ছড়া চা -বাগান। ওখানে গেলে দুনয়ন যে ভুলিয়ে দেবে। ওখানে যাবেন তো? বললাম, কেন নয়, তুমি যা বলবে তাতে আমার আপত্তির কারণ কোথায়! এবার সিলেটে গিয়ে উঠলাম জেলখানা রোডের ডালাসে। রুম ভাড়া ,১০০ টাকা করে। রুমে বসে দেখা মিলল সিলেট নগরীর কত না বহুতল ভবন। তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমেছে, তাই বের হলাম না। জানালার পাশে বসে দেখি, আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। একটু পরে শুরু হলো বৃষ্টি। বসে বসে দেখছি সিলেটের কতই না রূপ। সাকিব চৌধুরী বলল, বর্ষায় এখানে বৃষ্টি পড়ে, গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম, শরৎকাল, হেমন্তকাল, শীত, বসন্ত - এসবের দেখাও মেলে এই সিলেটে। জন্যই তো সিলেট অপরূপা। কত না লোক বেড়াতে আসে এই সিলেটে। একবার ঈদে আসবেন কিন্তু.... হ্যাঁ পরদিন সকালে গাড়ি পাঠিয়ে দিল বহুদিন আগের খুবই ঘনিষ্ঠ ছোট ভাই আফসার। গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা দুজন। প্রথমেই ছুটলাম খাদিমনগরের চা-বাগান দেখতে। মুরারি চাঁদ কলেজের সামনে গাড়ি আসতেই ড্রাইভারকে বললাম, এখানে গাড়ি রাখ। গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার একটু হেসে - তা, মুরারি চাঁদ কলেজ বুঝি আপনার প্রিয়? বললাম, কেন নয়? অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রইল যে এখানে। কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকে একটু এগিয়ে গেলাম পুরনো ভবনটির দিকে।

তখন কত স্মৃতি না ভেসে উঠল চোখের পাতায়। এখাইে সে ছিল বকুল তলা। এক পড়ন্ত বিকালে ভালো লাগা বাবলী নামের মেয়েটি আমাকে শুনিয়েছিল

সেই সুন্দর অভিসার লগনে

চাঁদ উঠেছিল বুঝি নীল গগনে

আমি চেয়েছিনু

দুটি ফুল দাও আমারে

তুমি চেয়েছিলেন

মোর পানে ক্ষণিক হেসে....

সেই চম্পা বকুল তলে

তোমারে দেখিছি... এই গানখানি।

তারপর কত বছর কেটে গেল। আজ আমি কোথায় (?) আর সেই বাবলীই বা কোথায়। মনে হয়, দুটি পাখি দুটি তীরে। আহা কোথায় গেল সেই দিনগুলো।

মুরাগি চাঁদ কলেজ কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে সাকিব চৌধুরী বললো, মদনমোহন কলেজ দেখে এবার চলুন মালিনীছড়া চা - বাগানে। চা-বাগান দেখে খুব ভালো লাগবে যে... পথে ঈদগাহ দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। সাকিব চৌধুরী বলল, চলুন, দেখবেন শাহী ঈদগাহ। মনে হলো, কত অপরূপ ঝলমলে এই শাহী ঈদগাহ। এটি স্থাপিত হয়েছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে। কয়েক মিনিট ঘরে ঘুরে দেখলাম। শাহী ঈদগাহ। তবুও দেখার ইচ্ছে পূরণ হলো না। মনে হলো, সিলেটের অভিজাত্য বাড়িয়ে দিয়েছে এই শাহী ঈদগাহও।

মালিনীছড়া চা-বাগানে ঢুকে তো অবাক হতেই হলো। পথের বাঁক এদিক - ওদিক চলে গেছে দেখি, মহিলা শ্রমিকেরা চা পাতা তুলছে। সেই ক্ষণে সাকিব চৌধুরীর মন বড্ড উতলা হয়ে উঠল ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বলল, চাচ্চু কয়েকটি ছবি তুলুন। ছবি তুলছি, তখন মিটি মিটি হাসছে। সেই ক্ষণ কী ভোলার। ভুলবোই বা কেমনে!! পড়ন্ত বিকালে এলাম আলী আমজাদের ঘড়ি দেখতে। কথায় কথায় সাকিব চৌধুরী বলল, ব্রিটিশ আমলে লাটকে চমকে দেয়ার জন্য ১৮৭৪ সালে লংলারপৃথিমপাশা এস্টেটের জমিদার আলী আমজাদ এই বিচিত্র বিশাল ঘড়ি স্থাপন করেছিলেন..... দেখুন, ওই যে সুরমা নদী। চলুন নৌকাতে বসে দুকূলের দৃশ্য দেখব।



নদীতে বেড়াতে গিয়ে দেখি, কতনা নৌকা ভেসে যাচ্ছে দূর অজানায়। সাকিব চৌধুরী বলল, ওই যে দূরে মেঘের মতো যা কিছু দেখছেন, ওই দিকেই আমাদের ভাদেশ্বর গাঁও। তখন মনে পড়ল ১৯৮৩ সালের কথা। ওই গাঁয়ে পত্রমিতা সাথী বাড়ি। পূর্ব ভাগ ভাদেশ্বর কত সুন্দর গাঁও। চিঠি লিখতাম একে অপরকে - তখন তো পত্র মিতালীর যুগ। সেই দিনগুলোতে কতই না ভেবেছি তাদেশ্বরকে নিয়ে। ভালোলাগা ভাদেশ্বরের সাথী একসময় আমার জীবন প্রদীপ নিভু নিভু করে দিয়ে যায়। তখন তো ভাবতাম, বেঁচে কী লাভ! দেবদাসের মতো হয়ে তবে হাতিপোতায় নয়, এই ভাদেশ্বর গিয়ে জীবনটা উৎসর্গ করে দিই!!... অতীতের সেসব কথা ভাবতে ভাবতে দেখি আমরা সুরমা নদীর মধ্যখানে চলে এসেছি। ওপারেও সিলেট। দেখেই যাচ্ছি আর তখনি মনে পড়ল গিরিন চক্রবর্তীর গাওয়া -

আমার গানের পাখি তোমার কানন ছায়

হারানো দিনের সুরে আজিও কাঁদিয়া যায়

তুমি বসি বাতায়নে গাঁথো মালা আনমনে....

ভুলে গেছো তুমি মোরে....

গানের এ্ই কথাগুলো।

হঠাৎ সাকিব চৌধুরীর জিজ্ঞাসা কী ভাবছেন? বললুম, সিলেটের সেই ক্ষণিকের সাথী কথা। জানো, সিলেট ভ্রমণ আবারও যে মনে একটুকু সুখ এনে দিল। জন্য তো বার বার ঘুরেফিরে আসি সিলেটে। ঈদে আসব....আসবই যে সিলেটে.... কারণ, ক্ষণিকের সাথী জীবন ভরিয়া খুঁজি।

-লিয়াকত হোসেন খোকন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ