দার্জিলিং: যেতে যেতে পথে


 

দিন কয়েক থাকলে হেঁটেই দার্জিলিং শহরটা দেখে নেওয়ার পরিকল্পনা করা যায়। শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখতে যাওয়া আর ২০ কিলোমিটার দূরের রক গার্ডেন্স দেখতে যাওয়া ছাড়া অন্য দ্রষ্টব্যগুলো সবই এদিকে-ওদিকে দু-তিন কিলোমিটারের মধ্যে। কিন্তু এতটা সময় আর হাঁটার উৎসাহ সবার থাকে না বলে শহর দেখাবার সাইট সিয়িং ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি পর্যটন বিভাগ ছাড়া বেসরকারি নানা সংস্থার বাস বা গাড়িতে সেভেন পয়েন্টস, ফাইভ পয়েন্টস দেখানোর ব্যবস্থা আছে।

সেভেন পয়েন্টস ট্যুরে আড়াই-তিন ঘণ্টায় দেখিয়ে দেওয়া হয় - হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান, জুলজিক্যাল পার্ক, টিবেটান রিফিউজি সেলফ হেল্প সেন্টার, রঙ্গিত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার, রোপওয়ে, তেনজিং গম্বু রক, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট, লেবং রেসকোর্স।

যদিও এত কম সময়ের মধ্যে চিড়িয়াখানাটাই ভালো করে দেখা হয় না, আর শেষ চারটে পয়েন্ট দেখিয়ে দেওয়া হয় গাড়িতে যেতে যেতে রাস্তার পাশ থেকে, তবু একবেলায় এই ট্যুর করে নিয়ে আরেকবেলায় যাওয়া যায় ফাইভ পয়েন্টস দেখতে।

ফাইভ পয়েন্টস ট্যুরে আড়াই-তিন ঘণ্টায় দেখানো হয় জাপানি বৌদ্ধ মন্দির, লালকুঠি, আভা আর্ট গ্যালারি, ধীরধাম মন্দির, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম।



আর আবহাওয়া ভালো থাকলে ভোর চারটে-সাড়ে চারটের সময় রওনা হয়ে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখিয়ে ফেরার পথে ঘুম মনাস্ট্রি, ন্যারো গেজ ট্রেনের বিখ্যাত বাতাসিয়া লুপ আর তার পাশের ওয়ার মেমোরিয়াল দেখিয়ে আনা হয়। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, চিড়িয়াখানা, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। টিবেটান রিফিউজি সেলফ হেল্প সেন্টার বন্ধ থাকে রবিবার। হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেটের ভেতরে যেতে চাইলে অনুমতি পাওয়া যায়, তবে তা রবিবার অর্ধদিবস ও সোমবার পূর্ণদিবস বন্ধ থাকে। বোটানিক্যাল গার্ডেন বন্ধ থাকে রবিবার ও অন্য ছুটির দিনে।

পাঁচ-সাত দিনের জন্য দার্জিলিং গেলে নিজের খুশিমতো একেকবেলা একেক দিকে হাঁটতে যাওয়া যায়। ম্যালের চৌরাস্তার কাছেই অবজারভেটরি হিলে মহাকাল গুহামন্দির, রাজভবন, জিমখানা ক্লাব আর তার নিচেই স্টাফ করা পাখি, সরীসৃপ, প্রজাপতির সংগ্রহ নিয়ে তৈরি ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। ছোট কিন্তু আকর্ষণীয় এই মিউজিয়াম খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। বুধবার বিকেলে আর বৃহস্পতিবার সারা দিনই বন্ধ।

চৌরাস্তা থেকে ২ কিলোমিটার হাঁটা দূরত্বে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। এখন নাম তেনজিং নোরগে মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। তার আগেই পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক। চিড়িয়াখানা খোলে সকাল ৮টায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই সুন্দর। দু-তিন ঘণ্টা চিড়িয়াখানা বেড়িয়ে তারপর ঘণ্টা খানেকে মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট দেখে নিচের রাস্তা থেকে শেয়ারের গাড়ি ধরে ম্যালের নিচে ফেরা যায়।
হিল কার্ট রোড থেকে নিচের উতরাই পথে হেঁটে পৌঁছতে হয় লয়েড বোটানিক্যাল গার্ডেনে। যাতায়াত আর ভেতরে ঘোরাঘুরির জন্য হাঁটতে হবে কয়েক কিলোমিটার। দু-তিন ঘণ্টা সময় তো লাগবেই। খুলে যায় সকাল ৬টার সময়। ভোরবেলা গিয়ে লাঞ্চের আগে ফিরে আসার পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

বিকেলের দিকে টয়ট্রেনে দার্জিলিং থেকে ঘুম পর্যš— ৭ কিলোমিটারের একটা জয় রাইড নেওয়া যেতে পারে। তবে টিকিটের খুবই চাহিদা, তার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে। হিল কার্ট রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতেও যাওয়া যেতে পারে ৫ কিলোমিটার দূরের বাতাসিয়া লুপ পর্যন্ত। ফেরার সময় বাস বা গাড়ি ধরে ফিরে আসা যায়। হাঁটার সময় পাশ দিয়েই আসতে-যেতে দেখা যাবে জয় রাইডের ট্রেন।

রেলস্টেশন থেকে ২ কিলোমিটার এগোলে রাস্তার ডান পাশে আভা আর্ট গ্যালারি। শিল্পী আভাদেবীর আঁকা ছবি আর এমব্রয়ডারির কাজ দেখা যায়। আরও ২ কিলোমিটার মতো এগিয়ে হিলকার্ট রোডের পাশের পাহাড়ে অসাধারণ অবস্থানে ভালি মনাস্ট্রি। তার ১ কিলোমিটার পরে ওয়ার মেমোরিয়াল ও বাতাসিয়া লুপ। পাহাড়ে চড়ার জন্য রেলপথকে ঘুরিয়ে গোল লুপের মতো লাইন পাতা হয়েছে এখানে। অপেক্ষা করলে বাতাসিয়া লুপে ট্রেনের ছবি তুলে ফেরা যাবে।

এত দূর না যেতে চাইলে রেলস্টেশনের কাছেই নিচের রাস্তায় ধীরধাম মন্দির যাওয়া যায়। নেপালের কাঠমান্ডুর বিখ্যাত পশুপতিনাথ মন্দিরের শৈলীতে তৈরি হয়েছে এই মন্দির।



রক গার্ডেন্স আর গঙ্গা-মায়া পার্ক যেতে হলে গাড়ি ভাড়া করে বা শেয়ারের গাড়িতে যেতে হবে। খোলা থাকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত। গোর্খা আন্দোলনের শহীদ নারী চুন্নুর নামে রক গার্ডেন্সের জলপ্রপাতের নাম এখন চুন্নু সামার ফলস। বাগান ও জলপ্রপাতে পরিবেশ দর্শনীয়। আরও দুই নারী শহীদের নামে হয়েছে গঙ্গা-মায়া পার্ক।
হ্যাপি ভ্যাটি টি এস্টেটে যেতে চাইলে যাওয়া যেতে পারে পথচলতি শেয়ারের গাড়ি ধরেও। আর হাঁটতে ভালো লাগলে আভা আর্ট গ্যালারি থেকে হিলকার্ট রোড ছেড়ে আরেক রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হ্যাপি ভ্যালি যাওয়া যায়। হাঁটতে হবে ৬-৭ কিলোমিটার। ফেরার সময় বড় রাস্তায় উঠে গাড়িতে ফেরা যায়।

তবে এর চেয়ে অনেক কম হাঁটায় মাল থেকে সি আর দাশ রোড ধরে ভুটিয়া বস্তি— পার হয়ে চলে আসা যায় লেবং রেসকোর্স পর্যন্ত। সি আর দাশ রোডেই দেখা যায় স্টেপ অ্যাসাইড, যে বাড়িতে মৃত্যু হয়েছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। আর কিছুটা এগিয়ে রায় ভিলা, যেখানে প্রয়াত হয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা। এরপর রাস্তা জিজ্ঞাসা করতে করতে এগিয়ে যেতে হবে ভুটিয়া বস্তির দিকে। তারপর ইচ্ছে হলে আরও এগিয়ে লেবংয়ের পথে যাওয়া যায়। পুরো রাস্তাটাই নিচের দিকে নেমে চলা, তাই কষ্ট হয় না। ফেরার সময় লেবং থেকে শেয়ারের গাড়িতে শহরে ফেরা যায়।

আবার চৌরাস্তা থেকে হেঁটে চলা যায় এর উল্টো পথে ঘুমের দিকে। ঘুম পর্যন্ত— যেতে ৮ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। চৌরাস্তা থেকে পাহাড়ের তিন ধাপে তিনটে রাস্তা চলেছে সেদিকে। তিনটেই হিলকার্ট রোডে গিয়ে মিশেছে জোড়বাংলোর কাছে। অতটা না হাঁটতে চাইলে গান্ধী রোড ধরে লালকুঠির গোর্খা হিল কাউন্সিলের অফিস বা জাপানিজ পিস প্যাগোডা পর্যন্ত ঘুরে আসা যেতে পারে। এর ওপরের রাস্তা ড. জাকির হোসেন রোড চলেছে জলাপাহাড় হয়ে। সেখানে ইয়ুথ হোস্টেল। আর আরেক রাস্তা তেনজিং নোরগে রোড গিয়েছে আলুবাড়ি মনাস্ট্রি হয়ে। হাঁটাপথে ঘোরার মতো সুন্দর জায়গা দার্জিলিংয়ের নানা দিকে। তবে যাঁরা হাঁটতে চান না তাঁরা সময় থাকে এক দিনের ট্যুরে দার্জিলিং থেকে ঘুরে আসেন ৫০ কিলোমিটার দূরের মিরিক লেক।

-লিয়াকত হোসেন খোকন।


6


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ