ময়মনসিংহ: উৎস ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সন্ধানে



 জমিদারি আমলের কীর্তিতে ভরপুর ময়মনসিংহ। পাশদিয়ে বয়ে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদ। অন্যতম আকর্ষণ মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্যের রাজবাড়ি ‘শশীলজ’। এই জেলায় আরও রয়েছে- গৌরিপুর রাজবাড়ি, মুক্তগাছার রাজবাড়ি, দুর্গাবাড়ি, কেল্লাপুর, বোকাইনগর দুর্গ, আলেকজান্ডা ক্যাসেল, মহারাজ শশীকান্তের বাড়ি, রাজেশ্বরী, বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি, আটানি জমিদার বাড়ির শিব ও গোয়াল মন্দির (মুক্তাগাছা)।

‘হাওড়-বাঁড়র-মোষের শিং, এই তিনে মিলে ময়মনসিংহ’। ময়মনসিংহে কখনো সিংহ ছিল না।সুতরাং সিংহ থেকে ময়মনসিংহ নামকরণ হয়নি।একদা এই অঞ্চলে প্রচুর মহিষ ছিল। মহিষের ‘শিং’থেকে যে ময়মনসিংহ হয়েছে একথাও কেউ বলেন না। এ অঞ্চল একদা ছিল সমুদ্রগর্ভে। খ্রিস্টের জন্মের পরবর্তীকালে গারো পাহাড়ের দক্ষিণবর্তী এলাকা ক্রমে সমুদ্রগর্ভ থেকে ভেসে উঠতে থাকে। অতঃপর ধীরে ধীরে বসতি গড়ে উঠতে লাগল। প্রথমে কামরূপের গারো ও কোচ-গোত্রের অধিবাসীরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করে।


ষোড়শ শতাব্দীতে বঙ্গের স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তাঁর পুত্র সৈয়দ নাসিরুদ্দিন নসরত শাহকে এখানে পাঠান। সে সময় এই এলাকার নাম হয় তাঁর নামানুসারে। পরে নসরত শাহীর যুগ কেটে গেলেও ‘নাসিরাবাদ’ নামটি হুবহু থেকে যায়।ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠার অনেক পরবর্তী সময় পর্যন্ত এই জায়গার নাম ছিল ‘নাসিরাবাদ’। মোগলদের আমলে মোমেন শাহ ছিলেন এই অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট পীর। সমগ্র অঞ্চলে ছিল তাঁর দারুণ প্রতিপত্তি।তাই সম্রাট আকবর তাকে দলভুক্ত করে নিলেন।পরবর্তী কালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে এই অঞ্চলের নাম হয় ‘মোমেনশাহী’ - অতঃপর ‘ময়মনসিংহ’।
কর্পোরেশন স্ট্রিটের পাশেই ‘শশীলজ’। একদা এখানে সর্ব সাধারণের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। সুরম্য ও সুরক্ষিত এই প্রাসাদের পাশ দিয়ে যেতে হলেও প্রজা সাধারণকে করজোড়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতে হতো। মাথায় কোনো ছাতা ব্যবহার করা যেত না। মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য তারই দত্তক পুত্র শশীকান্তের নামানুসারে ময়মনসিংহ শহরে একটি বিলাসবহুল সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদের নাম রাখা হয়‘ 'শশীলজ’। সেটি ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা। পরবর্তীকালে শশীকান্ত প্যারিস থেকে ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সংগীত-সিঁড়ি এনে স্থাপন করেছিলেন এই শশীলজে। এই সিঁড়ি বেয়ে উঠলে একধরনের সুর বেজে উঠত। শশীলজ দেখার পর‘গৌরীপুর লজ’ দেখার জন্য কাছে আসুন। এটিও আকর্ষণীয়। ব্রহ্মপুত্র নদের এক পাড়ে শুয়ে আছেন হযরত বুড়া পীর। মাজার জিয়ারত করে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা ঘুরে দেখুন। আলেকজান্ডা ক্যাসেলটিও দেখার মতো। এটি এককালে বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো । ১৯২৬ সালে এখানে আতিথ্য গ্রহণ করে গেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ময়মনসিংহে আরও দেখবেন গৌরিপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর বিলাসভবন। এটি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। দালান কোঠার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যই এই মনোরম কাঠের বাড়িটি তৈরি হয়েছিল। এটি নির্মাণের মিস্ত্রি ছিল চীনদেশীয়।ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি দেখে নিন। এটি এক সময়ে ‘সূর্যকান্ত হাসপাতাল’ নামেপরিচিত ছিল। টাউনহলটি বহু স্মৃতি নিয়ে আজদাঁড়িয়ে আছে। মহারাজ সূর্যকান্ত এটি প্রতিষ্ঠা করেন১৮৯৬ সালে। ‘ছায়াবাণী’ সিনেমা হলটি একদা ‘অমরাবতী নাট্যশালা’ নামে পরিচিত ছিল। ময়মনসিংহের দর্শনীয় প্রাসাদগুলোর মধ্যে এটিওপ্রাচীন।
ময়মনসিংহের পূর্ব নাম ‘নাসিরাবাদ’ ও ‘মোমেনশাহী’।এই জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, বানার, মহারানী নদী।
ময়মনসিংহ জেলায় উপজেলা মোট ১৩টি, এ গুলো হলো : ময়মনসিংহ সদর, হালুয়াঘাট, ভালুকা,ফুলবাড়িয়া, গফরগাঁও, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, ত্রিশাল, মুক্তাগাছা, ফুলপুর, তারাকান্দা, নান্দাইল ও ধোবাউড়া। এ জেলার আয়তন ৪,৩৯৪.৫৭ বর্গকিলোমিটার।
ময়মনসিংহ বর্তমানে বিভাগীয় নগরী।


নজরুলের ত্রিশাল ঃ
ত্রিশালে নেমে নিজেকে ভাগ্যমান মনে করবেন।নজরুল তাঁর যৌবনের প্রথমদিকে বহুদিন এখানেথেকে গেছেন। এখানে বটগাছের নিচে বসে নজরুলগান ও কবিতা রচনা করেছেন। বটগাছ এখনও আছে।নজরুলের স্মৃতি ছড়িয়ে দিচ্ছে এই বটগাছ। এটিত্রিশালের ছিলমপুর গ্রামে অবস্থিত। আজকালছিলমপুরকে কেউ ছিলমপুর বলে না, বলে বটতলা।সকুনি বিলের পাড়ে এই বটতলায় বসে নজরুল তাঁরছোটগল্প ‘অগ্নিগিরি’ লিখেছিলেন। এই গল্পে ময়মনসিংহের অনেক জায়গার নাম আছে।
মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি :
দেশের প্রাচীনতম জমিদার বাড়ির মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা জমিদার বাড়িটি অন্যতম। যথাযথ সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে ঐতিহাসিক এই জমিদার বাড়ির ভবন আজ ধ্বংসের পথে। মুক্তাগাছা শহরটির গোড়াপত্তন করেন বগুড়ার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী।১৭২৭ সালে তিনি আলেকশাহী পরগনার বন্দোবস্ত লাভ করেন নবাব আলীবর্দী খাঁর কাছ থেকে। এরআগে নাম ছিল মুক্তারাম। পরে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী তাঁর জমিদার বাড়ির নাম রাখলেন ‘মুক্তাগাছা’।মুক্তাগাছা জমিদারি প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী বগুড়া থেকে নৌকাযোগে মুক্তাগাছায় আগমনকরতেন। মুক্তাগাছায় গিয়ে দেখবেন তাঁর জমিদারবাড়ি, বাগানবাড়ি, পুকুর, রিভলভিং স্টেজ,হাতিশালা ও মন্দির।



একনজরে ময়মনসিংহের দর্শনীয় স্থান ঃ
নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র - ত্রিশাল। শহীদ আবদুল জব্বার জাদুঘর - গফরগাঁও। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা - ময়মনসিংহ। শশীলজ। গৌরীপুর হাউজ। রাজ রাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কাস। টাউন হল। মহারাজ সূর্যকান্তের বাড়ি - মুক্তাগাছা। কালু শাহ বা কালশার দীঘি। চীনামাটির ঢিলা - ধোবাউড়া। মনসাপাড়া সেভেনথ ডে এডভেন্টিন্ট সেমিনারি - ধোবাউড়া। রবার ডেম ও রবার বাগান - সন্তোষপুর। গারো পাহাড়। তেপান্তর স্যুটিং স্পট। উথুর কুমির প্রকল্প - ভালুকা। মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি। অর্কিড বাগান - ফুলবাড়ি। আলাদিনস পার্ক - ফুলবাড়ি। আলেকজান্ডার ক্যাসেল। স্বাধীনতা স্তম্ভ। বিপিন পার্ক। সিলভার ক্যাসেল। রাম গোপাল জমিদার বাড়ি। কেল্লা তাজপুর।

-লিয়াকত হোসেন খোকন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ