অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মণিপুর







লিয়াকত হোসেন খোকন:
ভারতের পূর্বাঞ্চলের ছোট্ট পাহাড়ি রাজ্য মণিপুর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে অসাধারণ। একদা ছিল স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। ১৮৯১ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মণিপুর রাজার ভাই টিকেন্দ্রজিৎ ধরা পড়েন। ১৩ আগস্ট ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝোলায় টিকেন্দ্রজিৎকে। আর এর ফলে শেষ হয় স্বাধীনতার। আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ওখানে ১৯৪৪ সালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করে রাখা হয়। আর স্বাধীন ভারতে মণিপুর সংযুক্ত হয় । আর ১৯৭২ সাল থেকে পূর্ণরাজ্যের মর্যাদা পায় ভারতীয় প্রজাতন্ত্র।

মনিপুর রাজ্যের পূর্বে বার্মা আর উত্তরে নাগাল্যান্ড রাজ্য। পশ্চিমে আসাম আর আংশিক দক্ষিণ-পশ্চিমে মিজোরাম। রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশই পাহাড়ি এলাকা। বাকি অংশ সমতল। পাহাড়ে নাগা, কুকি-চিনসহ ২৯টি উপজাতির বাস। আর সমতলের অধিবাসীদের নাম মীতেই। এরাই জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।

মীতেইদের মুখের ভাষা মণিপুরি। কিন্তু লেখার হরফ বা বর্ণমালা বাংলা। ধর্মে এরা বৈষ্ণবীয় হিন্দু। রাসলীলা ও দোলযাত্রা দুই প্রধান উৎসব। দুর্গাপূজায়ও উৎসব হয়। এসব সময় মণিপুর ভ্রমণ খুবই চিত্তাকর্ষক। আর পাহাড়ি উপজাতীয়রা অধিকংশই খ্রিষ্টান। এদের খ্রিষ্ট উৎসব ছাড়াও স্ব স্ব উপজাতীয় উৎসব পালিত হয় সাড়ম্বরে। মীতেই সম্প্রদায়ের মণিপুরী নৃত্য আজ দেশে-বিদেশে সুবিদিত। তেমনি আকর্ষণীয় মণিপুরি হস্তশিল্প। তাঁতবস্ত্র, বাঁশ ও বেতের তৈরি সামগ্রী, বিছানার চাদর, রং-বেরঙের ব্যাগ, মণিপুরি শাল ও মণিপুরি পুতুল অনন্য।
পাহাড়ি রাজ্য মণিপুর
আসামের শিলচরে একবার বেড়াতে গিয়ে মণিপুর রাজ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। আগেই জানতাম, মণিপুরের পাহাড়ে নাগা, কুকি, চিনসহ ২৯টি উপজাতির বাস। আর সমতল এলাকায় বাস করে ‘মীতেই’। মীতেইদের মুখের ভাষা মণিপুরি। ধর্মে এরা বৈষ্ণবীয় হিন্দু। সংখ্যায় মীতেইরা বেশি। এদের লেখার হরফ বা বর্ণমালা বাংলা। শিলচর থেকে মণিপুর রাজ্যের রাজধানী শহর ইম্ফল-এর দূরত্ব ২২৫ কিলোমিটার। পাহাড়ি পথ বলে বাসে পৌঁছতে ১০ ঘণ্টা সময় লেগে গেল। অরণ্যময় পাহাড়ি পথ ধরে বাস যখন চলছিল তখন দু’পাশের নয়নলোভা দৃশ্য দেখে প্রকৃতির প্রেমে যে মজেছিলাম।

মণিপুরের ইম্ফলে এসে উঠলাম হোটেল দিশ ডিলাক্সে। দু’দিন অবস্থান করে দেখে নিলামগোবিন্দজির মন্দির, মহাবলী ঠাকুরের মন্দির, মিউজিয়াম অর্কিডারিয়াম, ওয়ার সিমেট্রিস, শহীদ মিনার। মনে হলো, এই শহরের চারপাশে পাহাড়। শহরের পাশ থেকে বয়ে গেছে দুটি নদী এর একটির নাম শহরের নামে নামেইম্ফল, অপরটি ‘নাম্বুলা’। শহরে বাস, ট্যাক্সি, অটো, রিকশা সবই চলছে। রিকশা ভাড়া করে বেড়াতে গিয়ে রিকশাচালকের মুখে শুনলাম, তার নাম গোবিন্দ, আদিবাড়ি আসামের করিমগঞ্জে। বয়স সতেরো। বাংলায় কথা বলে তাই ওকে হোটেলে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। সন্ধ্যার পরক্ষণে গোবিন্দ আমাকে নিয়ে গেল গোবিন্দজির মন্দিরে। দেখলাম, মন্দিরে নাচ-গান হচ্ছে। এক বৈষ্ণবী এসে আমার কপালে চন্দন পরিয়ে দিল। বৈষ্ণবীর মুখে হাসি। এ অবস্থা দেখে গোবিন্দ আমাকে বলল, দেখলেন তো ওরা কতই না সহজ-সরল। ওদের অর্থাৎ মীতেইদের মধ্যে রয়েছে প্রেম ভক্তি। এরই ১ ঘণ্টা পরে গোবিন্দের সঙ্গে গিলাম খোয়াইরামবান্দ বাজারে। সেখানে গিয়ে দেখলাম মণিপুরি তাঁতবস্ত্র আর হস্তশিল্পের সামগ্রী।

ইম্ফল দেখার পরে বিষ্ণুপুরের দিকে রওনা হলাম। গোবিন্দ সঙ্গে ছিল। ইম্ফলের ২৭ কিমি পশ্চিমে বিষ্ণুপুর। এখানের বিষ্ণু মন্দিরটি দেখার পরে আরো ১৬ কিমি দূরের মোইরাং-এ এলাম। এখানের প্রধান আকর্ষণ মন্দির। এই মন্দিরে মণিপুরের অধিষ্ঠাত্রী প্রাচীন দেবতা থাংজিং রয়েছে। মন্দির সম্মুখে নাচ গান দেখে অভিভূত হয়ে মনে মনে ভাবলাম, আমাদের দেশের কমলগঞ্জ উপজেলার মণিপুরিরা নামে মণিপুরি কিন্তু নৃত্যগীতে এদের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। মোইরাং মেমোরিয়ালিট দেখতে গিয়ে জানলাম, ১৯৪৪ সালের ১২ এপ্রিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এখানে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

মেমোরিয়ালের সামনেই রয়েছে সুভাষ বসুর মূর্তি।
মোরে শহরে এক রাত থাকার কথাও মনে পড়ে। ইম্ফল থেকে মোরের দূরত্ব ১০০ কিলোমিটার। এখানে এক কর্মশালায় উঠেছিলাম। মোরের কাছে পিঠে বার্মার সীমান্ত। এটি এখন বাণিজ্যিক শহর।
মণিপুর রাজ্যে শৈল শহর হলো ‘উথ্রুল’। ইম্ফল থেকে এর দূরত্ব ৮০ কিলোমিটার। এখানে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বেশি। উথ্রুলে এক বেলা অবস্থান করে চুনা পাথরের গুহাটি দেখে ইম্ফলে ফিরে এসে লোকটাক লেক দেখতে গিয়ে বোটে বেড়ানোর সময় মীতেই উপজাতির এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয়। জানতে চাইলাম, আপনি কি বাংলা গান জানেন! হাসলেন!

পাহাড়ি শহর ইম্ফল ঃ
উপত্যকা আর পাহাড় এই দুই নিয়ে ভারতের মণিপুর রাজ্য। পাহাড়ি রাজ্য মণিপুরের রাজধানী শহর ইম্ফল। সুন্দর ছবির মতো সাজানো ছোট শহর ইম্ফল কয়েক দিন বেড়িয়ে প্রবল আনন্দ পাবেন। পাঁচটি জেলা নিয়ে গড়ে উঠেছে মণিপুর রাজ্য। পূর্ণিমার সময়ে গেলে প্রবল আনন্দ পাওয়া যায়। আকাশে তখন থাকে দোলপূর্ণিমার চাঁদ। দুধারের পাহাড়গুলো জোছনা গা ভাসিয়ে নিশ্চুপ একেকটি রূপকথার কেল্লা। ঐ সময় পাহাড়ি নদীর পাথরের গায়ে বারবার চাঁদের ছায়ায় ভাঙাগড়ার খেলা চলে।

কী দেখবেন - কী জানবেন ঃ
৭০০ মিটার উচ্চতায় মণিপুর উপত্যকার কেন্দ্রে ২৬ বর্গকিমি ছোট শহর ইম্ফল। এই শহরের চারপাশ পাহাড়ে ঘেরা। ইম্ফল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এক সুন্দর শহর। শহরের দুই পাশ থেকে বয়ে গেছে দুটি নদী। একটির নাম ইম্ফল নদী, অপরটি নাম্বুল নদী। শ্রীগোবিন্দজির মন্দিরটি এখানের সবচাইতে আকর্ষণীয় মন্দির। এখানে দেখবেন সোনার পাতে মোড়া গম্বুজ। এই মন্দিরে গেলে মণিপুরিদের নৃত্যানুষ্ঠান দেখতে পাবেন। ইম্ফল নদীতে আর নাম্বুল নদীতে পড়ন্ত বেলায় নৌবিহার করতে পারেন। নদীর দুই কূলে দেখবেন পাহাড়, অরণ্য। ঝরনার পর ঝরনাও চোখে পড়বে এখানে।

এখানের মিউজিয়ামে যাবেন। এটি সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রবিবার ছুটির দিন, তাই বন্ধ। মিউজিয়ামে দেখবেন রাজবস্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র ও নানা ঐতিহাসিক সামগ্রী।

ইম্ফল শহরের কেন্দ্রস্থলে ওয়ার সিমেট্রি দেখতে পাবেন। এখানে অবশ্যই যাবেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিস্থল এক লাইনে সাজানো দেখে দারুণ মুগ্ধ হবেন। একটি রেজিস্টার খাতায় নিহত সৈনিকদের নাম, ঠিকানা লেখা রয়েছে। ইচ্ছে করলে সৈনিকদের নাম, ঠিকানার কথাও জানতে পারেন। শহীদ মিনারটিও দেখে নিন।

ইম্ফল শহরের কেন্দ্রে খোয়াইরামবান্দ বাজার। এটিই এ শহরের প্রধান বাজার। এখানের ব্যাপারীরা সবাই মহিলা। এখানে গিয়ে মণিপুরি তাঁতবস্ত্র কিংবা ওদের তৈরি হস্তশিল্প সামগ্রী কিনতে পাবেন।
ইম্ফল শহর থেকে ৬ কিমি দূরে চিড়িয়াখানা। এখানে মণিপুরের নাটুনে হরিণ দেখতে পাবেন। এছাড়া আরো অন্যান্য বন্য প্রাণী রয়েছে।

এই রাজ্যের পূর্বে মায়ানমার আর উত্তরে নাগাল্যান্ড রাজ্য। পশ্চিমে আসাম দক্ষিণ-পশ্চিমে মিজোরাম রাজ্য। এই রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশই পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ে নাগা, বুকি, টিনসহ ২৯টি উপজাতির বাস। এখানে মীতেইদের বাস। এদের মুখের ভাষা মণিপুরি।

ইম্ফল থেকে ২৭ কিমি দূরে বিষ্ণুপুর। এখানে গেলে চৈনিকশৈলীতে নির্মিত বিষ্ণুমন্দির দেখবেন। ইম্ফল থেকে ৪৩ কিমি দূরে মোহরাং। এখানে রয়েছে একটি মেমোরিয়াল। লোকটাক লেকে যেতে ভুলে যাবেন না কিন্তু। ইম্ফল লেক ৪৮ কিমি দূরে। এখানে গিয়ে বিরাট এক হ্রদ দেখবেন। শুটিং, বোটিং, ফিসিং এসবের ব্যবস্থা আছে এই লেকজুড়ে।

কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক মণিপুর রাজ্যের আকর্ষণীয় এক এলাকা। এখানে গেলে মণিপুরি হরিণ দেখতে পাবেন। এছাড়া হগ ডিয়ার, ভোঁদড়, ভালুক রয়েছে এই পার্কে। লেক রয়েছে এখানে। নৌকায় করে লেকে বেড়াতে পারেন।

মায়ানমার সীমান্ত দেখতে চাইলে মোরে শহরে যেতে পারেন। ইম্ফল থেকে ১০০ কিমি. দূরে ‘মোরে’। এটি বাণিজ্যিক শহর। এখানকার পথশোভা খুবই সুন্দর। এখানের পাহাড়ে বসে সীমান্তের ওপারে মায়ানমারের তাঁবুও চোখে পড়বে। রাত যাপন করার জন্য মোরে শহরে হোটেল ও ধর্মশালা রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ