মণিপুরী অধ্যুষিত কমলগন্জে



মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত কমলগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ এলাকা পাহাড়ি বনাঞ্চলে আবৃত - এই জনপদে বসবাস করে মণিপুরী উপজাতিরা।

এছাড়াও বাস করে খাসিয়া, ত্রিপুরা বা টিপরা, গারো উপজাতি বা আদিবাসীরা। আরও রয়েছে বাঙালিদের বসবাস।
মণিপুরী উপজাতিদের কারণে কমলগঞ্জের খ্যাতি রয়েছে দেশ বিদশের মানুষের কাছে। বহু পর্যটক এই জনপদে আসা যাওয়া করেন মণিপুরীদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, উৎসব দেখার জন্য।

এখানের মণিপুরীরা ভাষাগত এবং ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে তিনটি শাখায় বিভক্ত - স্থানীয় ভাবে তারা মণিপুরী বা মৈতৈ ; মণিপুরী মুসলমান বা পাঙাল ও মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া বা বিষ্ণুপুরিয়া নামে পরিচিত।

১৯৭১ সালে কমলগঞ্জের মণিপুরী জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। মণিপুরী মহিলা ও গৃহবধূরাও নানানভাবে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সাহায্য সহযোগিতা করেন।

মহারাসলীলা উপলক্ষে কমলগঞ্জে বসে বড় ধরনের গ্রামীণ মেলা - মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়াও জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই উৎসব।

মহারাসলীলা উপলক্ষে যা যা হয় তাহলো - আলোচনা সভা, গুণীজন সংবর্ধনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ; নটকীর্তন ইত্যাদি সহ শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ করা।

জানা যায়, ১৭৭৯ সালে ভারতবর্ষের মণিপুর রাজ্যের মহারাজ ভাগ্যচক্র স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে প্রবর্তন করেছিলেন এ রাসনৃত্য উৎসবের। এরই ধারাবাহিকতায় কমলগঞ্জের মণিপুরীরা ১৮৪২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত স্থানীয় জোড়ামন্ডপে উৎযাপন করে আসছে এ রাসোৎসব।

১৯১৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরী শিল্পীদের পরিবেশিত রাসনৃত্য দেখে তিনি শান্তিনিকেতনে মণিপুরী নৃত্য শিক্ষার প্রবর্তন করেছিলেন। আর এজন্য কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কমলগঞ্জ উপজেলার মণিপুরী, খাসিয়া, টিপরা, গারোদের জীবনাচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কারণে এ অঞ্চলে গড়ে তোলা যেতে পারে একটি বিশেষ এলাকা আর তার নাম হতে পারে - উপজাতি শহর বা জনপদ কমলগঞ্জ। হতে পারে মণিপুরী নগরী নামে কমলগঞ্জের পরিচিতি।

কমলগঞ্জে দেখার আছে - চা বাগানের পর চা বাগান ; লাউয়াছড়া বন ; খাসিয়া পুঞ্জি ; মণিপুরী পাড়া ; ললিতকলা একাডেমি ; শমসের নগর বিমান বন্দর ; ক্যামেলিয়া লেক ; মাধবপুর লেক ; হামহাম জলপ্রপাত ; বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ ; মণিপুরী কালচারাল একাডেমি বা কমপ্লেক্স ; কালেঞ্জী পান পুঞ্জি ; ভানুবিল কৃষক আন্দোলন স্মৃতি কমপ্লেক্স ; আদমপুর বন ; চাউরা মেমোরিয়াল মণিপুরী প্রপার্টি মিউজিয়াম আর হাজারো প্রজাতির গাছগাছালি। তাছাড়া আছে - রাবার বাগান ; লেবুর বাগান ; আনারসের বাগান ; মূল্যবান গাছের বাগান আরও কত কি।




প্রকৃতি কমলগঞ্জের প্রাণ - তাই এখানের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেশ বিদেশের পর্যটকদের বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে। সেই সঙ্গে মণিপুরী সহ অন্যান্য উপজাতিদের জীবনাচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তো রয়েছে।
কমলগঞ্জের উল্লেখযোগ্য মেলা ও উৎসব হ'ল - শ্রী শ্রী ঠাকুরানী গুরুজী গোঁসাইর জন্ম মহোৎসব ; রাস পূর্ণিমা ; বারুণীর মেলা ; মুন্সিবাজার ঠাকুরানীর শ্রীধামের মেলা ; পতনঊষার বৈশাখী মেলা ; ছয়সিড়ি চরক পূজা ; শমসের নগর মোকামবাজার বার্ষিক ওরস ; মুন্সিবাজার ১০০ হাত বাসন্তী পূজা ; শমসের নগর পিঠা মেলা।
কমলগঞ্জ উপজেলার নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, মোগল আমলে এই এলাকা খাজনা আদায়ের কারণে নিলামে বিক্রি হলে নওগাঁ জেলার ধুবলহাটির জমিদার কিংকরিনাথ রায় চৌধুরী এই এলাকা কিনে নেন। তিনি এই এলাকার শাসনভার ন্যস্ত করেন বিচক্ষণ নায়েব কমল নারায়ণ রায়ের উপর। কমল নারায়ণ রায় শাসনভার হাতে পেয়ে নিজ নামধাম প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হন। তিনি ধলাই নদীর পূর্ব তীরে বর্তমান পানিশালা গ্রামে নিজের নামে কমলগঞ্জ বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। কালের বিবর্তনে কমলগঞ্জ বাজার বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাঁর নামে কমলগঞ্জ নামটি এখনও রয়ে গেল - যা কিনা আজকের কমলগঞ্জ উপজেলা।

কমলগঞ্জে থানা স্থাপিত হয় ১৯২২ সালে এবং উপজেলায় মর্যাদা পায় ১৯৮৩ সালে। কমলগঞ্জে পৌরসভা গঠিত হয় ২০০০ সালে।
ঢাকা থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটার।
কমলগঞ্জ উপজেলার আয়তন মোট ৪২৬.৭২ বর্গকিমি।
জনসংখ্যা ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট
২,৫৯,১৩০ জন।

কমলগঞ্জ উপজেলার উল্লেখযোগ্য স্থান হ'ল - রহিমপুর, পতনঊষার, মুন্সিবাজার, শমসের নগর, আলীনগর, আদমপুর, মাধবপুর, ইসলামপুর।
আর উল্লেখযোগ্য গ্রাম সমূহ হ'ল -
হকতিয়ারখোলা, কাটাবিল, কেওয়ালীঘাট, মধ্যভাগ, বনগাঁও, নওয়াগাঁও, উত্তরভাগ, জালালপুর, বন্দরগাঁও, কাউয়ারগলা, রাজকান্দি, আধগানী, কোনাগাঁও, ছনগাঁও, ভানুবিল, মাঝেরগাঁও, নয়াপত্তন, ঘোড়ামারাস , তিলকপুর, হোমেরজান, তেতইগাঁও, কান্দিগাঁও।
কমলগঞ্জ উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে ধলাই নদী।
কমলগঞ্জ উপজেলার উত্তরে রাজনগর উপজেলা ; দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ; পূর্বে কুলাউড়া উপজেলা ও ভারতের আসাম রাজ্য আর পশ্চিমে শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলা।

- লিয়াকত হোসেন খোকন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ