স্বভাবকবি হাছন রাজার সুনামগন্জে



হাওর-বাঁওড়ের জেলা সুনামগঞ্জ, বোরো ধানের জেলা সুনামগঞ্জ। আউল-বাউলের জেলা সুনামগঞ্জ। কারো কারো মতে, সুনামদি নামক জনৈক মুসলিম সেনাপতির নাম থেকে ঘুরেফিরে সুনামগঞ্জ নামকরণ হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, সুনামদি নামক জনৈক জেলে এখানে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে এখানে ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং জেলে সুনামদির নাম থেকে সুনামগঞ্জ হয়েছে।

আরও জানা যায়, সুনামউদ্দিনের ডাক নাম সুনামদি। কোনো এক যুদ্ধে বীরোচিত কৃতিত্বের জন্য সম্রাট কর্তৃক সুনামদিকে এখানে কিছু ভূমি পুরস্কার হিসেবে দান করা হয়। দানস্বরূপ প্রাপ্ত ভূমিতে তারই নামে সুনামগঞ্জ বাজার স্থাপিত হয়েছিল। সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র অঞ্চল এককালে আসামের কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল।
১৭৯০ সালে সুনামগঞ্জ থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। থানা সুনামগঞ্জ ১৮৭৭ সালে মহকুমা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সুনামগঞ্জের উত্তরে ভারতের আসাম রাজ্য, দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলা, পূর্বে সিলেট জেলা এবং পশ্চিমে নেত্রকোনা জেলা।
সুনামগঞ্জ জেলার আয়তন ৩,৭৪৭.১৮ বর্গকিমি ।
জনসংখ্যা ২৪,৬৭,৯৬৮ জন।
এই জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা, জাদুকাটা, পিয়াইন, সারী - গোয়াইন, সোনালী চেলা, ঘানুয়ারা, বোকা মহাসিংহ, খাজাঞ্চি নদীগুলো।
এই জেলায় উপজেলা ১১টি। এগুলো হলো -
সুনামগঞ্জ সদর, দিরাই, ছাতক, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, , জগন্নাথপুর, তাহেরপুর, শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর। এই জেলার কৃতী সন্তান মরমি কবি হাছন রাজা, রায় বাহাদুর, অমর নাথ রায়, অক্ষয় কুমার দাস। সুনামগঞ্জের বিশাল ভূখণ্ড যে সাগর বক্ষ থেকে জেগে উঠেছে সে সাগরকে কালিদহ সাগর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ কালিদহ সাগর সুনামগঞ্জের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
যেভাবে যাবেন ঃ
ঢাকা থেকে সড়কপথে বাসে সুনামগঞ্জ যাবেন। আম্বরখানা থেকে ট্যাক্সি ক্যাব কিংবা মাইক্রোতে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যেতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লাগবে।
যেখানে থাকবেন ঃ
সুনামগঞ্জে রাত যাপন করার জন্য বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। হোটেল প্যালেসে দ্বিশয্যার রুম ভাড়া ৩০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে। হোটেল নূর কিংবা হোটেল নূরানীতে উঠতে পারেন।
যা যা দেখবেন ঃ
সুনামগঞ্জ শহরে অবস্থিত হাছন রাজার বাড়ি‌ - এখানে তার ব্যবহৃত কিছু দ্রব্যাদি সংরক্ষিত রয়েছে। এসব সামগ্রী হলো - খড়ম, পোশাক, ছবি, তলোয়ার, প্লেট ও খাতা, রূপার পানদানি, কলম ইত্যাদি। শহরেই হাছন রাজার সমাধিসৌধ। এখানে এসে তা দেখে নিন। এবার আসুন হাছান রাজার ঘর যেখানে ছিল সেই জায়গায়। এখানে একটি টিনের ঘর দেখবেন। এরই পাশে অযতেœ বেড়ে ওঠা জঙ্গল। সেখানেই নাকি ছিল হাছন রাজার মূল ঘর। খড়ের ঘরেই হাছন রাজা থাকতেন।
সুরমা নদীর ওপারে রঙ্গারচর ইউনিয়নে মেঘালয়ের পাহাড় ঘেঁষে ডলুরা স্মৃতি সৌধের অবস্থান। এই স্মৃতিসৌধ দেখতে গিয়ে মেঘালয় পাহাড় দেখুন। ১৯৭১ সালে শহিদ ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে সমাহিত করা হয়। তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত হয়েছে ডলুরা স্মৃতিসৌধ। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পাগলা ইউনিয়নের অন্তর্গত পাগলা বাজারের কাছে অপূর্ব কারুকাজ শোভিত পাগলা জামে মসজিদ। এই মসজিদের সুন্দর গম্বুজ বহু দূর থেকে দৃষ্টি কাড়ে। নারায়ণতলা মিশনটিও দেখে নিতে পারেন। এখানে খ্রিস্টানদের একটি মিশন, গির্জা ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় আছে। শহরের পুরনো কালেক্টরেট চত্বরে রয়েছে টাউন জামে মসজিদ। এটি মনোরম, দেখতে ভুলে যাবেন না কিন্তু। গৌরা রং বেশি দূরে নয় - সেখানে গিয়ে দেখুন জমিদার বাড়ি। সৈয়দ উমেদ হারুন বোগদাদী (রহ.)-এর মাজার দেখবেন মোহাম্মদ গ্রামে।
জেনে রাখুন, সুনামগঞ্জের আবহাওয়া অত্যন্ত চমৎকার। বৃষ্টিপাতের জন্য এই জেলার রয়েছে বিশেষ পরিচিতি। বৃষ্টিপাতের গড় ২৮.৬ সেলসিয়াস থেকে ২০.১ সেলসিয়াস। এখানে বর্ষায় মাসিক গড় সর্বোচ্চ ৪০.৪৪ ইঞ্চি ও শুষ্ক মৌসুমে বার্ষিক ১১.৬৮ ইঞ্চি বৃষ্টিপাতের রেকর্ড রয়েছে।
প্রভূত খনিজসম্পদ, মাছ, পাখি, পানি আর ধান নিয়ে সুনামগঞ্জ। এ জেলায় বোরো ধানই প্রধান ফসল। এই জেলা উদ্ধৃত ফসলের এলাকা। মাছ এ জেলার অন্যতম অর্থকরী ও মূল্যবান সম্পদ। এখানে রয়েছে ১৩১৮টি ছোট-বড় জলমহাল। এখান থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় মাছ ও শুঁটকি রফতানি হয়ে থাকে। এখানের ছাতক উপজেলায় গেলে দেখবেন সিমেন্ট কারখানা। টেকেরঘাটে রয়েছে চুনাপাথর উত্তোলন কেন্দ্র।
হাওরে বেড়ানো ঃ
সুনামগঞ্জ জেলায় রয়েছে হাওর-বিল। আষাঢ় থেকে আশ্বিন পর্যন্ত হাওড় এলাকা থাকে সমুদ্রের মতো। তাই এ সময় ৩ থেকে ৪ দিনের জন্য নৌকা ভাড়া করে হাওরে বেড়াতে যেতে পারেন। সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় থাকা ও ঘুরে বেড়ানো নিরাপদ। নৌকা ভাড়া করবেন সুনামগঞ্জের সুরমা নদী থেকে। সুনামগঞ্জ থেকে বিশ্বম্ভরপুর যাওয়ার পথে দেখবেন করচার হাওর। এখানে চারদিকে অথৈ পানি। হাওর এলাকায় ১০ মাইল দূরে দূরে গ্রাম। শনির হাওর, টেঙ্গুয়ার হাওর, কাঙ্গলার হাওর, পাগলার হাওর, নলুয়ার হাওর প্রভৃতিও দেখবেন সুনামগঞ্জে। হাওর এলাকার হাটবাজারে গেলে বিভিন্ন ধরনের মাছ দেখতে পাবেন।



হাছন রাজা ঃ
সুনামগঞ্জে যে ক’দিন থাকবেন প্রতিদিন হাছন রাজার কথা মনে পড়বে। হাছন রাজা ছিলেন স্বভাব কবি। তার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি, পিতা ছিলেন দেওয়ান আলী রাজা। তার মাতার নাম হরমত জাহান বিবি। হাছন রাজা অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন। শিকার তার প্রিয় শখ ছিল। সংগীতে তার বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। অশ্বারোহণে তিনি সুপটু ছিলেন। দান-খয়রাতে তিনি মুক্ত হস্ত ছিলেন। তিনি নৃত্যগীতে সর্বদা বিভোর হয়ে থাকতেন। তিনি যেসকল গান রচনা করেন তা তিনি তাল-লয় সহকারে পরিজনদের মধ্যে শিক্ষা দিতেন। দেওয়ান হাছন রাজা মারা যান ১৯২২ সালে।
এক নজরে দর্শনীয় স্থান -
শ্রী শ্রী ঠাকুরাণীর থলা ; শাহ আরেফিন মাজার ; টাঙ্গুয়ার হাওর ; শিমুল বাগান ; নীলাদ্রি লেক ; সিরাজউদ্দীন লেক ; বাউল শিল্পী শাহ আবদুল করিম মিউজিয়াম ; সাচনা জমিদার বাড়ী ; হাসন রাজার বাড়ী ; নারায়ণতলা ও মিশন ; সৈয়দপুর গ্রাম ; পণতীর্থ স্মৃতি ধাম ; বাঁশতলা শহীদ স্মৃতিসৌধ ; লাউড়ের গড় ; ডলুরা স্মৃতিসৌধ ; টেকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প ; সুখাইড় জমিদার বাড়ী ; শাহ কালাম কোহাফাহ ( রঃ) এর রওজা ; পাইলগাঁও জমিদার বাড়ী ; গৌরারং জমিদার বাড়ী ; হাওলি জমিদার বাড়ী ; পানাইল জমিদার বাড়ী।
কত টাকা খরচ হবে ঃ
৪ থেকে ৫ দিন সময় হাতে নিয়ে যাবেন সুনামগঞ্জে। যেদিকে যাবেন সেদিকেই হাওর-বাঁওড় ও বিল-ঝিল। শরৎ ও হেমন্তে সুনামগঞ্জ অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে। বারবার এখানের সৌন্দর্যে মোহিত হবেন। এ ভ্রমণে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা খরচ হতে পারে।

লিয়াকত হোসেন খোকন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ