বেদে সম্প্রদায়ের জানা-অজানা কথা


 

নৌকায় বাড়িঘর। নৌকাতেই জম-মৃত্যু। আনন্দ-ফুর্তি-উৎসব। নদীরপাড়ে, খালের ধারে, বিলের অথৈ জলের বুকে ভেসে বেড়ায় যারা সারাটা জীবন, তারা হলো - ‘বেদে।’ এদেরকে বাইদ্যাও বলা হয়। নৌকায়ই এদের জীবন-যাপন কেউ মরে গেলে ওরা পানিতেই ফেলে দেয় বেশির ভাগ। বেদেরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। তাই ওদের হালচাল কোনো বিশেষ এলাকার লোকের মতো হয় না। কথাবার্তাও না। সমাজ ভিন্নতর। কথায় কোনো বিশেষ জেলার সুর নেই। তেমনি চালচলনও কোনো জেলার মানুষের মত নয়।

বেদেরা ডাঙায় বেরোয় দলেবলে। তেমনি জলপথেও একলা চলে না। একসঙ্গে দশ-বারখানা তো বটেই। সময়ে সময়ে চল্লিশ-পঞ্চাশখানি নৌকাও সাজিয়ে-গুছিয়ে ওরা জলে ভেসে বেরোয়। চারদিক জলে জলে থই-থই। একসঙ্গে অনেক নৌকো, এ দৃশ্য হৃদয়কে আকৃষ্ট করে। কখনও বা ঢেউ খেলানো শস্য খেতের পাশ দিয়ে হারিয়ে যাওয়া মেঠো পথ ধরে এরা বেতের ঝাঁপি কিংবা পুঁটুলি নিয়ে দল বেঁধে চলাচল করে। গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে চুড়ি, ফিতে, বাসন-কোশন, মাটির আসবাব, গাছের শেকড়, বিভিন্ন রোগের ওষুধ বিক্রি করে। সাপের খেলাসহ বিভিন্ন খেলা দেখায়। ‘কি সাপে দংশিল লখাইরে...’ গানের একথা শুনে শত ব্যস্ততার মধ্যে ছুটে যায় অনেকে। ভিড় করে। সাপের খেলা দেখে। কেউবা দেখে বেদেনীকে নয়ন ভরে।
বেদেদের ইংরেজিতে জিপসি বলা হয়। এদের আদি বাস কোথায়, কীভাবে উৎপত্তি - এসব প্রশ্নের জবাব আজও অজ্ঞাত। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বেদেদের আদি বাস ভারতে।’
বাংলাদেশের বেদেদের মধ্যে নয়টি উপগোত্র আছে। যেমন - লাউয়া, চাপইল্যা, বান্দইরা, মাল, সাপুড়িয়া, বাজিকর, মেল্লাছ, বেজ এবং গাইন। বেদেদের উপগোত্রের মধ্যে সাপুড়িয়াদের সংখ্যা বেশি। এদের প্রধান কাজ বন-জঙ্গল থেকে সাপ ধরা। ভয়ানক বিষর্ধর সাপ ধরে এরা। বিষদাঁত ভাঙে। তারপর খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। কিন্তু সাপ বিক্রি করে না।



মাল গোত্রের বেদেরা সাপের বিষ ঝাড়ার কাজ বেশি করে। বাতের তেল বিক্রি, শিঙ্গা লাগানো এবং দাঁতের পোকা ফেলার কাজও করে থাকে। তাছাড়া অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করে এরা। সাপ ধরে এবং তা বিক্রি করে। কিন্তু সাপের খেলা দেখায় না।
মেল্লাছ বেদেদের কাজ শিয়ালের হাঁড় সংগ্রহ করা। অতঃপর এগুলো বিক্রি করে যা উপার্জন করে তা দিয়ে এরা সংসার চালায়। এছাড়া এরা ধনেশ পাখি থেকে তেল বানায় এবং তা বিক্রি করে। বান্দইরা বেদেদেরে প্রধান কাজ বন-জঙ্গলে গিয়ে বানর ধরা এবং সেই বানর দিয়ে এরা নানা রকমের খেলা দেখিয়ে থাকে। কিন্তু এরা বানর বিক্রি করে না। এরা বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছড়ার ওষুধ বিক্রি করে।
বাজিকর গোত্রের বেদেদের মহিলারা তাবিজ-কবজ বিক্রি করে। পুরুষরা বিভিন্ন খেলা দেখায়। এদের প্রধান খেলা হলো, ডিগবাজি। এভাবে পয়সা উপার্জন করে এরা জীবিকা নির্বাহ করে।
বেজ গোত্রের বেদেদের প্রধান পেশা হলো, চোখের চিকিৎসা করা। এজন্য এরা গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায়। কাচ ভাঙা দিয়ে চোখে অস্ত্রোপচারও করে থাকে এরা।
গাইন গোত্রের বেদেরা বনেজঙ্গলে গিয়ে দারুচিনি, এলাচি, লবংসহ বিভিন্ন মশলা সংগ্রহ করে। এবং তা বিক্রি করে সংসার চালায়।
লাউয়া গোত্রের বেদেদের প্রধান পেশা মাছ ধরা এবং তা বিক্রি করা। এরা জাল দিয়ে মাছ ধরে না। বড়শি দিয়ে মাছ ধরে। সরাসরি তা নিয়ে বাজারে যায় না। মহিলারা মাছের ঝাঁকি নিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় এবং তা বিক্রি করে।
চাপাইল্যা গোত্রের বেদেদের প্রধান পেশা চুড়ি-শাখা-মালা বিক্রি করা। এছাড়া এরা মুক্তার বিভিন্ন ব্যবহার্য দ্রব্য ঝিনুক ইত্যাদি বিক্রি করে। এদের তৈরি পাখির হাড়ের মালা অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
আষাঢ়ের শুরুতে বেদেরা বেরিয়ে পড়ে নদীর পর নদী পেরিয়ে দূর-দূরান্তরে। গঞ্জে-গঞ্জে নাও ভিড়িয়ে সারাদিন ঘুরে এটা-সেটা বিক্রি করে কিংবা খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বর্ষা আর নদীতে যতদিন অথৈ পানি থাকে ততদিন এরা অজানার টানে ছুটে চলে।
অগ্রহায়ণের শুরুতে সারা দেশ জুড়ে শীতের আমেজ পড়ে এ সময় বর্ষার পানি সরে গিয়ে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে খটখট হয়ে যায়। তখন বেদেরা নদীর তীরে কিংবা খালের ধারে এসে নৌকা ভিড়িয়ে কিছুদিন রাখে। আবার কিছুদিন অন্যত্র। এভাবে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে।
চৈত্র মাসে বেদেরা ডাঙ্গায় মাচা তৈরি করে এবং সেখানে বসবাস করে। মাচা তৈরি করে নৌকার ছইয়ের মাঝে। মাচাগুলো বেশি উঁচু হয় না। মাচা তৈরি হয়ে গেলে নৌকার ছইগুলো তুলে এনে সেই মাচাগুলোর উপর বসিয়ে দেয়। তাছাড়া নৌকার সব জিনিস তুলে এনে ডাঙার আস্তানায় রাখে। আর নৌকাগুলো নদীতে ডুবিয়ে রাখে। এসময় এরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে।
আষাঢ় মাস আসতেই বর্ষার বানের পানি দেশময় থই থই করে ওঠে। তখন নৌকা তুলে তা সাজিয়ে-গুছিয়ে সেখানে বসবাস করে। অতঃপর সমস্ত জিনিসপত্র বোঝাই করে বেদেরা গা-ভাসান দেয় পানিতে অন্য মুলুকের সন্ধানে।
বেদেদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের লোক রয়েছে। বেশিরভাগ বেদে মুসলমান বলে দাবি করে। কিন্তু ইসলামের আচার-অনুষ্ঠান নিয়ম-কানুন এদের খুব কম সংখ্যকই মানে। এখনও এদের অনেকে ভূত-প্রেত আর দেব-দেবীতে বিশ্বাসী। সুতরাং এদের কে মুসলমান, কে হিন্দু সেটা বোঝা মুশকিল।
সরদারই হলো সর্বেসর্বা। সম্পূর্ণ ক্ষমতা তার হাতে। কে কোন দিকে যাবে, কোথায় অবস্থান করবে - সবকিছু নির্দিষ্ট করে দেয় সরদার। আইন ভঙ্গকারীকে তিনি শাস্তিও দিয়ে থাকেন। সরদারের ভরণ-পোষণের সমস্ত টাকা দিয়ে থাকে বহরগুলো। সরদারের নিচে হলো পরিচালক। বহরগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন সর্দার রয়েছে তেমনি উপ-গোত্রীয় সরদারও আছে। বেদেরা প্রতি বছর দেশের যেকোন এলাকায় মিলিত হয়ে উপগোত্রীয় সরদার নির্বাচন করে।
বেদে সমাজে পুরুষের চেয়ে মহিলারা বেশি কাজ করে। অত্যন্ত কর্মঠ এরা। জীবিকার জন্য এরা সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। ওদিকে পুরুষরা খুবই অলস। স্ত্রীদের আয়-রোজগারের ওপর অনেক স্বামী নির্ভরশীল। মহিলারা পুরুষদের মতোই স্বাধীন।
চৈত্র মাসের শেষ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্যে এদের বিয়ে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলো সম্পন্ন হয়। এক কথায় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে বিভিন্ন উৎসব, গান-বাজনা, নাচসহ আনন্দ-ফুর্তি চলে। তাছাড়া এ সময়ে ঝগড়া-ঝাটির মীমাংসাও হয়।
বেদেদের জীবনযাত্রা পুরোপুরি ভিন্নতর। তাই এদের সম্পর্কে জানবার আগ্রহের শেষ নেই। চলচ্চিত্রেও এরা ঠাঁই পেয়েছে। ১৯৩৯ সালে ‘সাপুড়ে’ নামক একটি ছবিতে সর্বপ্রথম এদের জীবনযাত্রা তুলে ধরা হয়। কাহিনীকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। পরিচালক-দেবকী কুমার বসু। অভিনয়ে - কাননবালা, পাহাড়ি স্যান্যাল, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মেনকা দেবী প্রমুখ। এ ছবিতে চন্দনরূপী কাননবালার গাওয়া ঃ ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই...’ এবং ' কথা কইবে না বৌ...’ গান দুখানি এখনও জনপ্রিয়। এর অনেক পরে ১৯৬২ সালে বেদেদের জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘জোয়ার এলো’ ছবিটি। ওই ছবিতে বেদেনী হয়েছিলেন সুলতানা জামান।

-লিয়াকত হোসেন খোকন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ